Berhampore Loksabha সাপলুডোর খেলায় অধীরের উত্থান, বাম পতন কোন পথে ?

Published By: Madhyabanga News | Published On:

Berhampore Loksabha ১৯৯৯ সালেই “ টিম অধীর চৌধুরী”র   নিজস্ব বাহিনী মাটি কামড়ে পরে থেকে  প্রায় সব বিধানসভা এলাকায়  কমবেশি  লিড নিয়ে  প্রায়  একলাখের  কাছাকাছি,   ৯৫ হাজার  ৩৯১ ভোটে জিতে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল। এই ভোটে কী করছে সেই টীম ? লিখছেন সাংবাদিক প্রাণময় ব্রহ্মচারী ।

 

Berhampore Loksabha ১৯৯৮সালের   ত্রিশঙ্কু লোকসভা ভোটের পর ফের একবছরের মাথায়   ১৯৯৯ সালে ভারতবর্ষ  অকাল নির্বাচন দেখল ।   সেদিক  থেকে দেখলে ১৯৯৯ সালের  বহরমপুর লোকসভা ভোটকে সাপলুডোর খেলার সাথে  তুলনা করা যেতে পারে  ।

কথায় বলে “ আজ য়ে রাজা, কাল সে ফকির” ।   বহরমপুর লোকসভা আসনের কথা ধরা যাক,    ১৯৫২ সাল থেকে  ১৯৯৯ ( মাঝে  ১৯৮৪- ৮৯ ৫ বছর অতীশসিংহর ইন্দিরা গান্ধী মৃত্যু জনিত সহানুভূতির কারনে হারা ছাড়া )   টানা ৪২ বছর ধরে দখলে রাখা বামফ্রন্টের  আরএসপির  দখলে থাকা বহরমপুর  আসনটি  চিরতরে কংগ্রেসের  অধীর চৌধুরীর কাছে  হাতছাড়া  হয়ে যায় ।

ত্রিদিব চৌধুরী,ননী ভট্টাচার্য, প্রমথেশ মুখোপাধ্যায়রা যখন বহরমপুরে  জেতাটাই  রুটিন মাফিক অভ্যেস করে ফেলেছিলেন , ঠিক তখনই   কংগ্রেসের  তরুণ তুর্কী  অধীর চৌধুরী শুধু  বহরমপুর দখলই করলেন না, সব হিসেব উলটেই দখল করলেন।

১৯৯৮ সালে  কংগ্রেসের  তৃতীয় স্থানে চলে গিয়েছিল। সেই   বাম দুর্গ বহরমপুরে    দু লাখ  ভোটে (  এক লাখ ৯৬ হাজার ৭৯৪ )  পিছিয়ে থাকা আসনটি  কিন্তু  ১৯৯৯ ভোটে সাপ লুডো খেলার মতোই এক্কেবারে  সব হিসেব – নিকেশ উলটে দিয়ে প্রায়  এক লক্ষ ( ৯৫ হাজার  ৩৯১)  ভোটে জিতে রাজনৈতিক কিস্তি মাত করেন অধীর ।

যা  বাংলার রাজনীতির ভাষায় “ অধীর ম্যাজিক”  শব্দবন্ধে  পরিণত হয়।   আরএসপি আর বহরমপুরে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।  বরং ১৯৯৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বহরমপুরে আরএসপির পথ ধরেই    কংগ্রেসের  অধীর চৌধুরীর সেই  জয়যাত্রা এখনো অব্যাহত।   ত্রিদিব  চৌধুরীর ১৯৫২ থেকে  ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত  ৩২ বছরের  সাংসদ  ইনিংসের   মতোই এখন  পর্যন্ত  টানা ২৫ বছর   অধীর চৌধুরীও জেতাটাই অভ্যেস করে  ফেলেছেন ।  তবে ১৯৯৯ সালে বিজেপি  ও বামেরা তাকে   হারাবার  কম চেষ্টা করেনি।  অথচ  বিজেপির  কর্ণেল সব্যসাচী বাগচী  মাত্র বছর খানেক আগেই ১৯৯৮ সালে ২,৬২,৬১০ ভোট পেয়ে  দ্বিতীয় স্থানে উঠে  আসা ভোট ও   ধরে রাখতে  পারেননি । বরং ১,৩৪,৫৬৯ ভোট পেয়ে সাপলুডোর খেলার মতো বিজেপিকে  তৃতীয় স্থানে চলে য়েতে হয়েছিল ।

যদিও  কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী  অটল বিহারি বাজপেয়ী  থেকে, প্রমোদ  মহাজন,  সিকান্দার বখত,তপন শিকদার, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীদের মতো নেতারা  বহরমপুরে প্রচারে ঝড়  তুললেও সেই  ঝড় অকাল কালবৈশাখীর ঝড়ে সব মিলিয়ে গিয়েছিল ।

১৯৯৯ সালের ভোট এই অধম কলমচির ব্যক্তিগত জীবনে  চিরতরে দাগ কেটে গিয়েছে ।   যদিও এখন  অপ্রাসঙ্গিক তবুও  ব্যক্তিগত অনুভূতি শেয়ার  করতে বাধ্য হচ্ছি ।  সেটা  হলো ভোট  চলাকালীন মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই  মা সেরিব্রাল এটাক হয়ে মারা গেলেন । অশৌচ   অবস্থায় ভোট কভার করতে হয়েছিল । যেদিন  ঘাট- কামান  হয় সেইদিনই  বহরমপুর ওয়াই এম এ ময়দানে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর সভা ছিল ।  মস্তক মুণ্ডিত  করে পাজামা পাঞ্জাবী  পরে প্রেস এনক্লোজারে ঢুকতে গিয়ে  চরম বাধার মুখে  পড়তে হয়েছিল ।  প্রেসকার্ডের  , এক মাথা চুল  ভর্তি ছবিরসাথে চেহারা  মিলছেনা ।  এসপিজি টিমও  ঢুকতে দেবেনা । আমিও নাছোড়বান্দা ।  এরই মধ্যে  মঞ্চে অটলবিহারির প্রবেশ । এদিকে  প্রায়  আমাকে  উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদী অভিযোগে গ্রেফতার  করে  আর কি ।  কিন্তু  উনি  গন্ডগোল দেখে  মঞ্চে ঘোষক প্রমোদ মহাজনকে কি যেন  বললে । প্রমোদ মহাজন   আর তপন শিকদার  দুজনেই নেমে এসে এসপিজি কমান্ডারকে বুঝিয়ে  আমাকে এনক্লোজারের ভেতরে নিয়ে গেলেন ।  ওনারা দুজনেই আমার পূর্ব  পরিচিত ছিলেন,  মাতৃবিয়োগের ব্যাপার আগে  থেকেই জানতেন ।  শুধু  তাই  নয় বাজপেয়ীজি ও বক্তব্য রাখতে  উঠেই সেই  কথা  তুলে  দু:খ প্রকাশ ও  করেন ।   অপর দিকে যে  রাতে মা মারা যান, তার পরদিন ভোরবেলায় অধীর চৌধুরীর সাথে  সফরসঙ্গী হয়ে  কেতুগ্রাম যাওয়ার কথাছিল ।  কী ভাবে  উনি  লালদুর্গে ভোট  প্রচার করেন তা চাক্ষুষ করার কথা ছিল ।  কিন্তু   মাকে  খাগড়া শ্মশানে শেষবিদায়  জানিয়ে  ভোরবেলায় মনখারাপ করে বাড়ি ফিরেছি।   হঠাৎ  ইন্দ্রপ্রস্থের বাড়িতে ল্যান্ডলাইনে  অধীর চৌধুরীর ফোন।  উনি বলেছিলেন,  অনেক রাতে প্রচার সেরে বাড়ি ফিরে খারাপ খবর টা শুনলাম।   অত ভোরে আমার বাড়ি  আসতে চান। তারপরে কেতুগ্রাম বেড়িয়ে  যাবেন । আমি ওনাকে  কোনোরকমে আমার  বাড়িতে  না এসে ওনার  পূর্ব নির্ধারিত  কেতুগ্রামের প্রোগ্রামের জন্য  বেড়িয়ে য়েতে অনুরোধ  করি ।   উনিও আমার  কথায়  নিমরাজি হয়ে  চলে যান।

যদিও এই দুই ঘটনার উল্লেখ   ” ধান ভানতে শিবের গীত ” গাওয়ার মতোই কাকতালীয় ঘটনা ।   কিন্তু ১৯৯৯ সালের ভোটের  কথা মনে  করলেই আজও মনক্যামেরায় ভিড় করে ।       সে সময় বহরমপুর লোকসভার মধ্যে   বর্ধমানের কেতুগ্রাম বিধানসভা ছিল ।   আর সেখানে প্রায় ফি ভোটেই ৩৫/ ৪০ হাজার  ভোটে লিড নিয়ে  মুর্শিদাবাদে  প্রবেশ করত বামেরা।  কিন্তু ১৯৯৯ সালে  কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি  ও অধীর চৌধুরীর  টিমের অন্যতম  বিস্বস্ত সৈনিক  মৃন্ময় রায়,  জাহাঙ্গীর কবীর, বুলবুল, ওয়াহেদ রেজা   ( কান্দির প্রাক্তন সিপিআই বিধায়ক ,মন্ত্রী) প্রমুখেরা  মাটি কামড়ে সেই  ৩৫ হাজারের  লিড প্রায়  ১৫ হাজারের নিচে  নামিয়ে আনে।   এটাই অধীর চৌধুরীর  বহরমপুর দখল  করার অন্যতম টার্নিং  পয়েন্ট ছিল।

তখন  আরএসপির দূর্গ ছিল  ভরতপুর, বড়ঞা, নওদা ও বেলডাঙ্গা বিধানসভা গুলি ।    আর কংগ্রেস কান্দি ও  বহরমপুরে শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে থেকেও মোট  ভোট অংকে কেতুগ্রাম  সহ বাকি  ৫টি বিধানসভায় পিছিয়ে  পড়ত  ।

কিন্তু  ১৯৯৯ সালেই “ টিম অধীর চৌধুরী”র   নিজস্ব বাহিনী মাটি কামড়ে পরে থেকে  প্রায় সব বিধানসভা এলাকায়  কমবেশি  লিড নিয়ে  প্রায়  একলাখের  কাছাকাছি,   ৯৫ হাজার  ৩৯১ ভোটে জিতে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল।

মুর্শিদাবাদ  জেলা  শুধু  নয়, রাজ্যের রাজনৈতিক  মহলে এবিএ গণিখান  চৌধুরী ও প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর সাথে একযাত্রায়  লোকসভায় সাংসদ  হিসেবে    প্রবেশ করে অধীর  ওই দুই  নেতার  মতোই নিজের   আসনটিও পাকা করে ফেলেছিলেন ।

সেদিনের  “অধীর টিম”এর   প্রথম সারির সৈনিকগণ    য়েমন  নিয়ামত সেখ, আবু তাহের খান , হুমায়ুন কবির,  রবিউল আলম চৌধুরী, অপূর্ব  সরকার প্রমুখ   এখন  শিবির পাল্টে বিরোধী শিবিরের মুখ ।

তারা সকলেই গুরু  অধীর চৌধুরীর “নাড়ি নক্ষত্র”   জেনে    “গুরু মারা বিদ্যে”  দিয়ে  এবার  তাদের একদা রাজনৈতিক গুরুকে বধ করার ছক কষছেন ।   কিন্তু   সেই  অঙ্ক  সফল হবে  কিনা তা  এখনই বলার সময় আসেনি।

প্রায়  এক মাসে  গঙ্গা, পদ্মা,ময়ুরাক্ষী নদীর   জল কোথায় গিয়ে  দাঁড়ায় তার  জন্য  অপেক্ষা  করতেই হবে। তবে  এটা বলতে দ্বিধা নেই   ১৯৯৯ সালের থেকেও এবারের  বহরমপুর ভোট ময়দানের টার্নিং  পিচে বল কিন্তু  অনবরত ঘুরছেই ।   প্রতিপক্ষের দুই  বোলার  ক্রিকেটার  ইউসুফ পাঠান  ও ডাক্তার প্রার্থী  নির্মল সাহা পিচ আঁকড়ে পড়ে আছেন।  এবার  সাত সাতটি বিধানসভাতেই তৃতীয়  হয়ে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ১২৬ ভোটে পিছিয়ে  থেকে  ঘরের পিচে ছবারের শক্ত ম্যাচ খেলতে  নেমেছেন অধীর চৌধুরী।  কিন্তু  তিনি এখনো  অন্তত মুখে আত্মবিশ্বাস বজায় রেখে  বলে চলেছেন,  “ আমি মানুষের ভালবাসা, দোয়ায় ভরসা রাখি ।  তারা আমাকে দু’হাতে  উজাড় করে  ভোটদিয়ে বার বার  আমাকে  জিতিয়ে  সংসদে পাঠিয়েছেন  এবারও তার অন্যথা  হবেনা ।   যাতে মুর্শিদাবাদের মানুষ,  বহরমপুরের মানুষ  নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন  তার সব ব্যবস্থা করার জন্য   নির্বাচন কমিশনকে বলেছি ।  তারা আস্বস্ত করেছে”।

অধীর বলছেন, “ আর যদি  একটা  বুথেও রিগিং করতে পারে  তাহলে রাজনীতি করা ছেড়ে দেবো”।     এখন  দেখার বিষয়  ১৩ মে  “ভোট  ম্যাচের”    দিন  কী   হয়। রেজাল্ট যদিও ৪ জুন।

লেখক সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত