অনির্বাণ দে, কৃষ্ণনগরঃ পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া (Nadia) জেলার মায়াপুর বামনপুকুর গ্রামের বাসিন্দা মৌমিতা সাহা মা হতে চলেছেন। যে সন্তান আসতে চলেছে তার জন্য এক বেলা বাড়তি খাবার খেতে হয়, আয়রন ট্যাবলেট খেতে হয়। পরিশুদ্ধ জল ( Safe drinking water) পান করতে হয়। মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নিয়ম। কিন্তু তার সাথেই বাড়তি একটা দায়িত্ব আছে মৌমিতার।
মৌমিতার কথায়, এই কাজও তো আমাদের সন্তানদের জন্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। কী সেই কাজ ? “জল বাঁচানো” , সহজ হাসি হেসে জানিয়েছেন মৌমিতা। তবে মুখে বলতে সহজ হলেও এই কাজ মোটে সহজ নয়। পাইপ লাইনে বাড়িতে যে জল আসে সেই জল মেপে খরচ তো করতেই হয়। আশেপাশের মানুষকেও বোঝাতে হয় যাতে কেউ জল অপচয় না করে। গ্রামের জল বাঁচাও কমিটির একজন সদস্যও মৌমিতা।
আরও পড়ুনঃ Jalangi River: নদীর জন্য একটা দিন
নদীয়া জেলার আরেকপ্রান্তে জানকিনগর হাই মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমিনও এই কাজই করেন তবে নিজস্ব ঢঙে। সাহসী হিসেবে সাবিনার পরিচয় আছে স্কুল থেকে পাড়ায়। তাই কোথাও জল অপচয় দেখলে, সাবিনা সেখানে ছুটে যান বন্ধুদের নিয়ে। কখনও ধমক দিতে হয়, কখনও বুঝিয়ে বলতে হয়। লক্ষ্য একটাই জল অপচয় বন্ধ করা।
গ্রামের মানুষ পাইপ লাইন ফাটিয়ে সেই জল চাষের কাজে ব্যবহার করছিলেন। কেউ কেউ সেই জল পাম্প লাগিয়ে তুলে রাখছিলেন ট্যাঙ্কে। এতে সরকারি জল ট্যাঙ্ক থেকে দূরবর্তী বাড়িতে পৌঁছাচ্ছিল না। এই সমস্যা দূর করেছেন কৃষ্ণনগর এক নম্বর ব্লকের অসীমা মোদকের টিম। অসীমা মোদক নিজে একজন স্বনির্ভর মহিলা। তিনি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী। অসীমা পাড়ায় তৈরী করেছেন মেয়েদের দল। যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাম্প ফাটিয়ে জল নেওয়া থেকে শুরু করে জল ট্যাঙ্কে তুলে রাখার মতো কাজ বন্ধ করেছেন।
কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের গৃহশিক্ষিকা ঝর্ণা মণ্ডলও একভাবে রুখেছেন গ্রামে ‘জল চুরি’। ঝর্ণা নিজের বাড়িতেই পড়ান স্কুলের কচিকাঁচাদের। তারাও আজকাল দিচ্ছে জল অপচয়ের খবর । সবাই মিলেই ছুটে যাচ্ছে বাড়ি বাড়ি।
কিন্তু এতো কিছু থাকতে “জল চুরি”, “জল অপচয়” নিয়ে এতো মাথা ব্যাথা কেন ? নদীয়ার দৈয়ের বাজার বিদ্যামন্দিরের ক্লাস টেনের ছাত্রী অরুণিমা ঘোষের স্পষ্ট জবাব, “জল চুরি যাওয়া মানে তো আমাদের ভবিষ্যৎ চুরি। জল অপচয় মানে ভবিষ্যতের অপচয়। আমাদের নিজের স্বার্থেই রাস্তায় নামা”।
এরকমই ২৪ জনকে বিশ্ব জল দিবসে সংবর্ধনা জানানো হল নদীয়ার কৃষ্ণনগরের রবীন্দ্রভবনে। শুক্রবার বিশ্ব জল দিবস ( World Water Day 2024) উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নদীয়ার জেলা শাসক এস অরুণ প্রসাদ ( S Arun Prasad) । তিনি জানিয়েছেন, রাজ্যে জল জীবন মিশন ( Jal Jeevan Mission) প্রকল্পে সব থেকে ভালো কাজ হয়েছে নদীয়া জেলায়। রাজ্যে প্রথম স্থানে নদীয়া। দ্রুত এই জেলায় একশো শতাংশ বাড়িতে পৌঁছে যাবে নল বাহিত পরিশুদ্ধ পানীয় জল। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়িবাড়ি পরিশুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে। শুক্রবার নদীয়ার জেলা শাসক আরও বলেন যে, জল সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝার জন্য বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাটাও ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝা উচিৎ।
নদীয়া জেলায় ছাত্র, ছাত্রী ও সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ জল সংরক্ষণের কাজে এগিয়ে আসছেন। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলা শাসক । পশ্চিমবঙ্গ সরকার জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২২ মার্চ অবধি পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী নদীয়া জেলার ১১ লক্ষ ৮৯ হাজার ৬১ টি বাড়ির মধ্যে ৯ লক্ষ ৬৩ হাজার ২২৮ টি বাড়িতে পরিশুদ্ধ পানীয় জলের সংযোগ পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে। মোট বাড়ির ৮১.০১ শতাংশ বাড়িতে রয়েছে এই জলের সংযোগ। রাজ্যের ক্ষেত্রে এই হার ৪৬.০৭ শতাংশ।
সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী নদীয়া জেলার ২৬৩ টি গ্রামে একশো শতাংশ বাড়িতেই পরিশুদ্ধ পানীয় জলের সংযোগ রয়েছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফ-এর একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, গ্রামের মহিলাদের কাছে পানীয় জল সংগ্রহ করা একটি কঠিন কাজ। প্রায় ৫৪ শতাংশ গ্রামীণ মহিলাকে প্রতিদিন জল বয়ে নিয়ে আসতে হয়। এই কাজের জন্য প্রতিদিন ৩৫ মিনিট সময় যায়। তার সাথে রয়েছে বাড়তি পরিশ্রম।
ওই রিপোর্টে জানানো হয়েছে , জল বইতে গিয়ে মহিলাদের প্রতি বছর ২৭ দিনের মজুরি লোকসান হচ্ছে। তবে কিছুদিন হল এই রকম সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছেন নদীয়ার বেতনা গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক সবিতা বিশ্বাস । কয়েক বছর আগেও পানীয় জল আনার জন্য ক্ষতি হতো চাষের কাজে।
আরও পড়ুনঃ UNICEF India: শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান করে পুরস্কৃত কোন কোন রেডিও প্রোগ্রাম ?
পাড়ার মোড়ে লাইন দিয়ে জল নিতে হতো। অন্যের জমিতে কাজ থাকলে সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারতেন না। হতো ঝগড়াও। পরিশুদ্ধ পানীয় জল বাড়িতে পোঁছানোয় হাতে অনেকটা সময় পাওয়া যাচ্ছে। সেই সময় বাঁচিয়ে চাষের কাজে দিচ্ছেন তিনি। কখনও আবার পড়াচ্ছেন ছেলে, মেয়েকে।
জলের সমস্যা মেটায় আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন হরিণঘাটা ব্লকের কাস্টডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের সাতশিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা গান্ধারী পোদ্দার। তিনি জানাচ্ছেন, আগে জল কিনে খেতে হতো, সেটা অনেকটাই খরচ সাপেক্ষ বিষয় ছিল। আবার জল খেয়ে অসুখ হতো। তখন আবার বাড়তি খরচ। তবে পাইপ লাইনের জলে সেরকম সমস্যা হয় না। মেয়েদের আর জল আনতে যেতে হয় না কোথাও। এতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজে সময় দিতে পারেন মহিলারা।
ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি বিভাগের আধিকারিক সুস্মিত বাগচী, সুদীপ ঘোষ, শামীদ্বীপ ভট্টাচার্য্য।
২০১৯ সালে প্রকাশিত National Compilation on Dynamic Ground Water Resources of India, 2017 পানীয় জল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ওই রিপোর্টে রয়েছে, ভূগর্ভস্থ জল-ই ভারতের কৃষিক্ষেত্র ও গৃহস্থলির প্রয়োজনে ব্যবহৃত জলের অন্যতম উৎস । রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, গ্রামীণ জল সরবরাহের ৮৫ শতাংশ আসে এই উৎস থেকেই।
শুক্রবার আলোচনায় জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের আধিকারিকরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জল নিয়ে। জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি বিভাগের আধিকারিক সুস্মিত বাগচী জানান, প্রত্যেকের বাড়িতে সরকারের পক্ষ থেকে পরিশুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এবার দরকার সচেতনতা। এই জল আমরা সঠিক ভাবে ব্যবহার না করলে, অপচয় করলে আগামী দিনে জলকষ্ট দেখা দিতে পারে। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, ছাত্রছাত্রী থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকা, গ্রামের মানুষ সবাই একজোট হলে জল অপচয় বন্ধ করা যাবে এবং পরিশুদ্ধ পানীয় জলের মূল্য সকলকে বোঝানো যাবে।
এই ধারণার সঙ্গে সহমত নদীয়ারই শিকারপুর বিবেকানন্দ হাই স্কুল ফর গার্লসের দশম শ্রেণীর ছাত্রী তৃষা বিশ্বাস । তিনি ক্লাসে, মাঝে মধ্যেই সহপাঠীদের জলের ক্লাস নিচ্ছেন। পাড়াতেও কেও জল চুরি করলে ডেকে বুঝিয়ে বলছেন। না কথা শুনলে খবর দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের আধিকারিকদের । তবে তৃষার কথায়, এখন বেশিরভাগ মানুষই জলের গুরুত্ব বুঝছে।
গ্রামের মানুষকে পরিশুদ্ধ পানীয় জলের গুরুত্ব বোঝানোর কাজ করছে নদীয়ার জল জীবন মিশনের আইএসএ। ওই সংস্থার কর্মীরা জানিয়েছেন, জল চুরি, জল অপচয় রুখতে গ্রামের মহিলা আর ছাত্রীদের জুড়ি মেলা ভার। সকলকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে, ঐক্যবদ্ধ করেই জল সংরক্ষণের লড়াইয়ে সৈনিক হয়ে উঠছেন মহিলা কৃষক , স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী থেকে স্কুলের ছাত্রীরা।
ঋণঃ https://ruralindiaonline.org/en/articles/water-not-any-drop-to-drink-bn/
( প্রতিবেদক একজন স্বাধীন সাংবাদিক। শ্রম, জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক উদ্যোগের বিষয়ে আগ্রহী )