Bengal Election Campaign: ভোট রঙ্গের ভোল বদল

Published By: Madhyabanga News | Published On:

Bengal Election Campaign কেমন ছিল ভোটের ছড়া ? ভোল বদল হল দেওয়াল লিখন থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় ? দাদা ঠাকুর বিদূষক পত্রিকায়   লিখলেন “  রমণী জিতেছেন, হেরেছেন নীলমণি ।  সবই টাকার খেলারে ভাই ।   Raw money র সঙ্গে কি Nil money জিততে পারেন”। এমনই ছিল তার তীব্র রসবোধ ।   ভোটের ছড়ার সেই সুদিন কি গিয়েছে ? কেমন হচ্ছে নতুন ছড়া ? কলম ধরলেন প্রাণময় ব্রহ্মচারী।

 

 

Bengal Election Campaign  ভোট  রঙ্গমঞ্চে ব্যঙ্গ  থাকবে না ?    তাই কি কখনো হয় !  ভোটের ছড়া  অনেকটা যেন  জল আর মাছের মতো । একসময়   সেই তীব্র শ্লেষ,  কটাক্ষ   নিমেষেই রাতের অন্ধকারে দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা  হয়ে  ছড়িয়ে পরার পর লোক মুখে ফিরতো ।  এখন  ভোটের ছড়ার সেই সুদিন গিয়াছে ।    ফ্লেক্স, সমাজমাধ্যম তাকে অনেক কোনঠাসা করেছে ঠিকই  কিন্তু এখনো  তাকে এক্কেবারে  জুরাসিক পার্কের বাসিন্দা করতে পারে নি ।  ফিনিক্স পাখির  মতোই বারবার সে এসেছে  ফিরিয়া,  বলছেন প্রবীণ  দেওয়াল লিখন শিল্পী  দীপক ঘোষ ।

তার  কথায়  ভোটের ছড়া, কার্টুন  দেওয়ালে লিখেই সেই সত্তরের দশক থেকে   প্রচার  হতো দেওয়ালে। তিনি বলছেন, “  দেওয়াল   লিখনের মাধ্যমেই, মানুষ তখন  প্রার্থীর নাম জানতেন, আমাদেরও দু পয়সা ইনকাম হতো।  এখনো  হয়। তবে পসার কমেছে”।

২০০১ সাল থেকে  ফ্লেক্স, ব্যানার  ও সোস্যাল মিডিয়া বেশি  ব্যবহার  হচ্ছে  তাই দেওয়াল লিখন কমেছে ।   কিন্তু   অনেকেই জানেন না  ,এই দেওয়াল দখল, চুনকাম করা, রাত জেগে দেওয়াল লেখার জন্য  ভোট বাজারে দলীয় কর্মীরা এক্কেবারে  চাঙ্গা হয়ে যায় ।

এ বঙ্গে ভোটের ছড়ার জনক হিসেবে কৃতিত্বের অন্যতম  দাবিদার কিন্তু  মুর্শিদাবাদ জেলার সাংবাদিক, ছড়াকার প্রকাশক, জঙ্গিপুরের ভূমিপুত্র শরৎচন্দ্র পন্ডিত ।    যিনি সারা বাংলায়  ” দাদাঠাকুর  ” নামেই  বেশি পরিচিত। তার বিদূষক পত্রিকায় প্রকাশিত হতো হরেক রকমের ভোটের ছড়া,গান ।  এমনকি দাদাঠাকুর  সিনেমায় কিংবদন্তি গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত কমেডি গানটি আজও  ভোটের ছড়ার গান  হিসেবে “ সিগনেচার”-এর   দাবি রাখে।

সেই গানে ছিল,  “ ভোট  দিয়ে যদুর কপালে ভোট দিয়ে যা।  মাছ কাটলে মুড়ো দেবো, গাই বিয়োলে দুধ দেবো, দুধ খাওয়ার বাটি দেবো,সুদ দিলে টাকা  দেবো,ঘি দিলে উকিল হবো, চাল দিলে ভাত দেবো ।  মিটিংয়ে যাবোনা, আমি অবসর পাবোনা,  কোনো কাজে লাগবো না” ।

আজ বরং   বহরমপুর পৌরসভা  ভোটের এক ছড়ার কাহিনি শোনানো যাক।  ভোটে দাঁড়িয়েছেন রমণী  মোহন সেন ও নীলমণি ভট্টাচার্য ।  দাদা ঠাকুর বিদূষক পত্রিকায়   লিখলেন “  রমণী জিতেছেন, হেরেছেন নীলমণি ।  সবই টাকার খেলারে ভাই ।   Raw money র সঙ্গে কি Nil money জিততে পারেন”। এমনই ছিল তার তীব্র রসবোধ ।  তিনি  ভোট কীর্তন গান ও লিখেছেন যা  দাদাঠাকুর সিনেমায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ।

সেই গানে ছিল, “ আমি ভোটের লাগিয়া ভিখিরি সাজিনু ফিরিনু দ্বারে দ্বারে / আমি   ভোট  ভিখিরি নই, আমি ভোট শিকারী গো”। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যও দেওয়াল লিখন নিয়ে  ছড়ায়   লিখেছেন,   “ দেওয়ালে দেওয়ালে মনের খেয়ালে লিখি কথা / আমি য়ে বেকার  পেয়েছি লেখার স্বাধীনতা”।

আজকাল দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা  মনের স্বাধীনতাই য়েন হারিয়ে গিয়েছে ।   তার জায়গায়  স্থান  পেয়েছে ব্যক্তিগত কুৎসা, নৈতিকতার বাইরে আক্রমণ।  তবে  সেই  ব্যক্তি আক্রমণের ছড়া আগেও ছিল ।   য়েমন যুক্তফ্রন্টের আমলে দেওয়ালে বামেরা লিখেছিল, “ দু আনা সের দেখে   বাজারে  কিনতে গিয়ে  হলুম  প্রফুল্ল (সেন) /  বাড়িতে এনে দেখি বেগুনটা কানা অতুল্য”।  অতুল্য ঘোষ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এক চোখ অন্ধ  ছিলেন বলে তাকে  কানা বেগুন / কানা অতুল্য বলে বামেরা ব্যঙ্গ করতেন ।

কংগ্রেস পালটা লিখল “ টাটা বিডলার সাথে প্রেম করিতে প্রমোদ ( দাশগুপ্ত) , জ্যোতি (বসু)  পটু / ঘর করিল, ছেলে  হলো নাম রাখিল CITU” ।   পাল্টা সিপিএম জুড়ল,         “ ঠিক  বলেছিস, ঠিক  লিখেছিস ভাই / ১১ই মার্চ ১৯৭২ তোদের ইন্দিরাকে সাজিয়ে আনা চাই”।  আরও লেখা  হলো,  “ দিল্লি থেকে এলো গাই !  সঙ্গে বাছুর সিপিআই”।    ১৯৭২ সালে  কংগ্রেস বিধানসভায়  জিতে দেওয়ালে লিখলো “ হরে গেল,কেষ্ট গেল ,গেল কেজি বসু / ( হরেকৃষ্ণ কোঙার,কৃষ্ণপদ ঘোষ,কে জি বসু)  বংশে কেবল বাতি দিতে রইলো জ্যোতি বসু”।   সিপিএম ও কবি সুকান্তভট্টাচার্যর কবিতার লাইনে  জবাব দেয় “আদিম হিংস্রতার  আমি যদি কেউ হই/ স্বজন হারানোর শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই”।

১৯৭১ সালের ভোটে  যুক্তফ্রন্ট দেওয়ালে শ্লোগান লিখল,    “ আদি, নব, ডাঙ্গে, ধাড়া ( আদি কংগ্রেস,নব কংগ্রেস, বাংলা কংগ্রেস, সিপিআই) / এবার  হবে বাংলা ছাড়া”।

দেওয়াল লিখনের মাধ্যমে তখন  আন্তর্জাতিক বিষয় ও উঠে আসতো।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জয়ের কীর্তি  উল্লেখ করে কংগ্রেস দেওয়াল ছয়লাপ করে দিয়েছিল, “ এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ জিও”।

পালটা দেওয়ালে লেখা হয়েছিল, “ সাট্টা  খেলো, দারু পিও/ ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ  জিও”।   আর সেই ছড়ার জবাবে   লিখেছিল কংগ্রেস,  “  আমরা দিনের বেলায় কোউটা নাচাই, রাত্রে করি ফিষ্ট ,  তারপরে বিষ্ট হয়ে হই মোরা কমিউনিষ্ট”।

বোফর্স কেলেংকারির জন্য  তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী  রাজীবগান্ধীকে ব্যক্তি আক্রমণ করে বিরোধীরা শ্লোগান লিখল,  ” অলি গলি মে শোর হ্যায়  / রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়!” ।  দেওয়ালে লেখা হয়েছিল, “ জহরের নাতি তুমি, ইন্দিরার ছেলে / বোফর্স কামান কিনে  রাজীব তুমি কত টাকা পেলে ?”।

১৯৯৬ সালে  বহরমপুরে সিদ্ধার্থ শংকর রায় ভোটে দাঁড়ালে তাকে শোলে সিনেমার ভিলেন  গব্বর সিং বানিয়ে  কার্টুন চিত্র আকা হয়েছিল । লেখা ছিল, “ শো যা  বেটা নেহি তো গব্বর ( সিদ্ধার্থ)  আয়েগা”।

এবার  হাল আমলে আসা  যাক ।   এক্কেবারে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করে দেওয়াল লিখন,  “ মোদি তুমি দুষ্টু লোক/তোমার সাদা চুলদাড়িতে উকুন হোক” । বিজেপি  আবার  উষা উত্থুপের গানের প্যারডি করে লিখেছে,  “ উরি উরি বাব্বা কি দারুন খবর ! গোয়ালঘরে সিবিআই খুঁড়ছে  কবর /  খুঁজেছে  ইধার কা মাল উধার কা কালা ধন রুপাইয়া”।   এবার  বামেরা বিজেপি, তৃণমুলকে  উদ্দেশ্য করে লিখল, “ বিকায় ছবি, বিকায় কোট কালো টাকার দরে /দুর্নীতিতে  সমান  সমান তফাত শুধু নামে” ।   এছাড়াও  বাম – কংগ্রেসের  দেওয়াল লিখনে আছে,  “ গরীবের  টাকা নিলো সারদার দিদি / কয়লা থেকে বালি  এখন  ভাইপোর ই গ্রিপে/ জমিয়ে ঘুষ নিল, এসএসসি আর টেটে / কাটমানিও লাগে এখন  ঢুকতে কলেজের গেটে”।   সিপিএমের  সুজন চক্রবর্তী যাদবপুর ছেড়ে  দমদমে প্রার্থী  হওয়ায়  লেখা  হল দেওয়ালে “সুজন সুজন কূজন ভাই / নেই কোকিলের  কূজন ওই/ হারতে হারতে হেরো / তৃণমূল ই গেরো/  যাদবপুরের ক্যাম্পাস / আর কেউ নেই চার পাশ”।

পাল্টা  জবাব  সিপিএমের,  “ বাংলা  আমার  সব বুঝেছে / এগিয়ে এসো খেলা  হবে হবে খেলা হবে / দিদির  দলে থেকে  যারা / চুরি করে রাজা  হলো /  চৌকিদারের  দলে গিয়ে  তারাই আবার  নাম লেখালো /  দুই দলের সাথেই  খেলা হবে, খেলা হবে”।

আবার সিপিএম   টুম্পা সোনার গানের প্যারডি করায় তাদের নিয়ে লেখা হল  , “ দ্যাখো ডান বাম মিলে যায় / সিদ্দিকীকেও নেয় / দ্যাখো  ওরা মার্ক্সকে ভুলে  ওরা  এখন  টুম্পা সোনার গান গায়”।  করোনা ও ইস্যু  হয়েছে বহরমপুরের অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে।   দেওয়াল লেখা হয়েছে,  “ করোনার সময় অধীর তোমার দেখা নাই /তাই  তোমার  ভোট নাই”।

বিজেপির বিজ্ঞাপন  ” বহরমপুরের সাংসদ  দিল্লির পরিয়ায়ী সাংসদ /তাই আপনার আমার ঘরের ছেলে,ডাক্তার বাবুকে  ভোট দিন” ।  এছাড়াও সমাজ মাধ্যমের দেওয়ালে দাবি করে লেখা হয়েছে,   কেকেআর এর ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান, কীর্তি আজাদ, শত্রুঘ্ন সিনহা ওনারা বহিরাগত নন, ওনারা বাংলা কৃষ্টি, ক্রীড়া সংস্কৃতির  উজ্জ্বল  তারকা প্রার্থী।  তাই ওদের  জেতান।  বিজেপি,সিপিএম  দলগুলোই বহিরাগত তাই ওদের  বর্জন করার জনগর্জন  তুলুন ।   সাথে সাথে  মিম করে পরেশ রাওয়াল, নানা পাটেকর, আমির খানরা হাসতেও ভুলে গিয়ে বলছেন  “আয়লা  বাপ, বলতা কিউ ভাই” ।   এভাবেই  এখনো কি আসল দেওয়াল ,সোস্যাল মিডিয়ার দেওয়ালেও  কতই  ভোটের  রঙ্গ দেখি দুনিয়ায় ভাইরে।  সেই  ট্রাডিশন সমানে আজও চলিতেছে।