বেদান্ত চট্টোপাধ্যায়ঃ শরীরের অর্ধেক অংশই আর পাঁচজনের মতো কাজ করে না। তবুও মুর্শিদাবাদের গণপতি আদর্শ বিদ্যাপিঠের ছাত্র মহম্মদ আলম রহমান স্বপ্ন দেখে বিজ্ঞানী হওয়ার। গতকাল মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরেই বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন আলম কে আরও উজ্জীবিত করে তুলেছে। মহম্মদ ২০২২ এর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আলমের প্রাপ্ত নং ৬২৫। বাংলায় তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৯১, ইংরেজিতে ৮৬, অংকে ৯৮,ভৌতবিজ্ঞান ৯৪, জীবনবিজ্ঞান ৭৭, ইতিহাসে ৮৪, ভূগোলে ৯৫। নিজের স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ সে পার করে ফেলেছে। এবার লক্ষ্য পূরণের আশা। শুধু তো শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়; ছোটো থেকেই দারিদ্রের সংসারে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এসেছে। তবে কোনো বাঁধাই বাধা হতে দেয়নি আলম, পাশে ছিল বাবা- মা, বন্ধুরা।
আলম বলছেন, “মনের জোরটাই আসল। আমি আরও ভালো ফল আশা করেছিলাম।আব্বা – মা, আমার শিক্ষকরা সবাই আমায় অনেক সাহায্য করেছে। আমি তো একা কিছুই করতে পারিনা!”
আলমের মা জানিয়েছেন, ছেলে কে এখনো খাইয়ে দিতে হয়। বই পত্র এগিয়ে দিতে হয়। কিন্তু ছোটো থেকেই পড়াশোনার প্রতি ভীষণ আগ্রহ। আলমের মা আরও বলেন, “ছেলে কে ঝড় বৃষ্টিতেও বাড়িতে রাখতে পারিনি। স্কুল থেকে কাদা মেখে উঠে আসতো। তবুও কোনোদিন স্কুল যাওয়া বন্ধ করেনি। ওঁর বাবা ওকে বেশিরভাগ দিন সাইকেল করে দিয়ে আসতো। কোনোদিন আটকে রাখলে কান্নাকাটি করতো স্কুলে যাওয়ার জন্য!”
বেশিক্ষণ নিচু হয়ে লেখা বা পড়া সম্ভব নয়;বেশিক্ষণ ঘাড় ঝুকিয়ে পড়াশোনা করলে শিরদাঁড়ায় শুরু হয় অসহ্য যন্ত্রনা। তবুও তাঁর ইচ্ছে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার। চোখে স্বপ্ন বিজ্ঞানী হওয়ার, গবেষণা করার , নিজের দেশের জন্য জেলার জন্য কিছু করে যাওয়ার।আলম অবসর সময় গল্পের বই পড়েন। কবিতা লেখেন। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য প্রেমিও সে। পা দিয়েই ছবিও আঁকেন। সেই ছবি প্রদর্শীত হয়ে বহরমপুরের প্রতিবন্ধী সম্মেলনে।
আলমের বাবা পেশায় মুদি ব্যবসায়ী, মা গৃহবধূ, আর রয়েছে দুই ভাইবোন। অভাবের সংসার। তবুও ছেলের স্বপ্ন পূরণে কোনো খামতি রাখেনি বাবা মা। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আলমের মা নিজেই পড়িয়েছেন, কিন্তু তারপরে দুই গৃহশিক্ষক দিতে হয়েছিল। ছেলের এই অভূতপূর্ব সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে আলমের মা এর গলা যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো কান্নায়। তবে এটা আনন্দের অশ্রু। আলমের সাফল্যে খুশি তাঁর পরিবার, বন্ধু বান্ধব সকলে। আলম বলে, আমি তো কিছু করতে পারিনা, স্কুলে আমায় টিফিন খাইয়ে দেওয়া, জল দেওয়া, বই বের করে দেওয়া, সবই আমার বন্ধুরা করত!আমার স্যাররাও আমায় খুব সাহায্য করেছে।”
তবে বর্তমানে আলমের সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা তাঁর স্বপ্ন পূরণ। কারণ ঐ গ্রামে ভালো স্কুল নেই। পড়তে হলে আসতে হবে শহরের স্কুলে। কিভাবে ছেলের স্বপ্ন পূরণ হবে চিন্তায় বাবা মা। আলমের এই সাফল্যে খুশি জেলাবাসি। ছেলের স্বপ্ন যাতে পূরণ হয় তাঁর জন্য সরকারের কাছেও আবেদন জানাচ্ছেন তাঁর বাবা মা।
আলমের মনের জোর আবারও প্রমান করলো আসলে যেকোনো সমস্যাই মানুষের ইচ্ছের কাছে হার মানতে বাধ্য। মুর্শিদাবাদের আলম ভাঙা ঘরের চাঁদের আলো নয়, সে নিজেই চাঁদ;তাঁর আলোয় আলোকিত হোক হাজারো আলম, এমনটাই সকলের চাওয়া। এবার দেখার পালা আলম নিজের স্বপ্ন কতটা পূরণ করতে পারে!