বিশেষ প্রতিনিধিঃ ওঁরা সাহায্য চায় না কাজ চায়! কিন্তু কাজ কে দেবে ওঁদের? কবিও তো লিখেছেন “বিধাতার দান প্রকৃতিতে মিশে জন্মায় অর্ধনারীশ্বর!” কেন মানুষ কেন নয়, মানুষ বলে সম্বোধন করা যায় না?, আজ একবিংশ দাঁড়িয়েও এমন প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের। আজ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে সকলে সাহায্য পেলেও ওঁদের জন্য কোনো প্রকল্প নেই। ওঁরা ট্রেনে, বাসে, রাস্তায় ‘হাতে তালি’ দিয়ে কিছু টাকা রোজগার করে, যদিও তার বিনিময়ে অনেক কটুকথা,খারাপ ব্যবহারও সহ্য করতে হয়! কথা হচ্ছে সমাজের অন্য একদিকের ; যেসকল মানুষ কে সমাজ আখ্যায়িত করেছে ‘হিজড়া ’, ‘ছক্কা’, ‘তালিবাজ’ ইত্যাদি আরও বিভিন্ন নামে!
মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তেও এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। রাস্তা- ঘাটে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেলেও তাঁদের কিছু অংশকে দেখা যায় বহরমপুর থেকে কৃষ্ণনগরগামী ট্রেনে | বিশেষ সূত্রে মধ্যবঙ্গ নিউজ খোঁজ নিয়েছিল ওঁদের!কেমন আছে ওঁরা, কেমন ভাবে ওঁদের জীবন কাটছে? ওঁদের একটি গোষ্ঠীর যাত্রা পথ বেলডাঙা থেকে পলাশী এবং আরেক গোষ্ঠীর যাত্রা পথ পলাশী থেকে কৃষ্ণনগর। ওঁরা যখন ট্রেনে ওঠেন তখন অনেকেই ওঁদের সাহায্যের বদলে মুখ ফিরিয়ে নেন । কেউ দু, পাঁচ টাকা দিলেও সেটা ভীষণ তাচ্ছিল্যের সাথে । আবার কেউ ভালোবেসেও কিছু সাহায্য করেন। এমনটাই জানাচ্ছেন তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ট্রেনের কামরায় নিত্য সাহায্য প্রার্থী রেশমা হালদার (নাম পরিবর্তিত )| রেশমার মতো আরও অনেকেই ওঠেন প্রত্যেক দিন! “ট্রেনের অনেক যাত্রী বলে আপনারা খুব রূঢ়, লোকজনের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেন!”
উত্তরে সবিতা (নাম ও পরিচয় পরিবর্তিত ) বলেন, “দাদা আমরাও মানুষ, আমাদের কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয় না | লোকজন মুখের উপরে না বলতে পারে। কিন্তু সেটাও করে না পুরো পাথর হয়ে বসে থাকে।” সবিতা আরও বলেন “আমরা এই লালগোলা শিয়ালদা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে কোনো মানুষের কাছে অনেক দাবি করিনা। আজ লোকজনের খারাপ ব্যবহার আমাদের বাধ্য করেছে ওঁদের সাথে অমন ব্যবহার করতে! ” এতো কথার সাথে সাথে একটু ক্ষোভ ও রাগের সাথেই পাশ থেকে রেশমা বলেন “আপনাদের কারও বাড়িতে কাজ করতে চাইলে দেবেন তো? কোনো অফিসে ঝাঁট দেওয়ার কাজ হলেও হবে,এমন কেউ আছে যে আমাদের কাজ দেবে? তাহলে আর কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতে হয়না!”
লকডাউন অতিমারী ওঁদের জীবনেও বড়ো থাবা বসিয়েছিল। পলাশী স্টেশনে নামার আগে আবারও একটু ক্ষোভের সাথে একজন বলেন “এই করোনার সময় আমাদের গোষ্ঠীর কতমানুষ অসুস্থ হয়েছে, সমস্যায় পড়েছে, কেউ তো সেদিন খবর রাখেনি ”। সবিতা, রেশমা, মহুয়ার মতন আরও কয়েকজন জানান, “ট্রেনে যত লোক ওঠে সবাই যদি আমাদের ১ টাকা করেও দেয় তাও অনেক!কিন্তু লোকজন তো আমাদের জন্মের পর থেকেই ভয় পেয়ে গেল!কেউ ভাবলোই না আমরাও মানুষ!”
রেশমা,সবিতা, মহুয়া, রুমি এঁদের জীবন আর পাঁচজনের থেকে অনেকটাই আলাদা কেউ একটু বড়ো হতেই বাড়ি থেকে বিতাড়িত, আবার কেউ বাড়ির মধ্যে থেকেও অচ্ছুৎ। সদ্য যেকোনো সরকারি ফর্মে লিঙ্গ নির্বাচন করার তৃতীয় লিঙ্গের একটি অপশন থাকে, কিন্তু তবুও কি সমস্যার নিস্পত্তি হয়েছে! সমস্যার নিস্পত্তি দূর,কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা বেড়েছে, এমনটাই অভিমত ওঁদের। জেন্ডার স্টাডিজের ছাত্রী সবিতা দাস জানাচ্ছেন, “সরকার যদি খাতায় কলমে এগোনোর সাথে সাথে বাস্তবিক দিক থেকেও ওঁদের কথা ভাবতো তবে ওঁদের অনেকেই ট্রেনে তালি বাজিয়ে টাকা চাইতে হতো না | সেটা মুর্শিদাবাদের ট্রেন হোক বা ভিক্টরিয়ার মোড়!”