নিজস্ব সংবাদদাতা, বহরমপুরঃ মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুর থেকে জাতীয় সড়ক ধরে বালুরঘাটের দিকে এগোলেই উত্তরপাড়া মোড় থেকে বাঁ দিকে সোজা গেলেই প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত একটি সুপ্রাচীন গ্রাম কাঁঠালিয়। চারিদিকে সবুজে মোড়া এই গ্রাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে কিছু দূর গেলে সারি সারি চাষের জমি। তার মধ্যদিয়ে হেঁটে চলেছেন গ্রামের মানুষেরা। আরও একটু ভেতরে গেলে ভাগীরথীর কাটা অংশ এখানে রয়েছে। যা যতদিন যাচ্ছে ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে অশ্বখুরাকৃতি হ্রদের। বরই অদ্ভুত এবং বৈচিত্র্য ময় এই গ্রাম। আবার পুরোপুরি গ্রামও বলা চলে না। কারণ রাস্তা এখানকার পিচের। বাড়িগুলো বেশিরভাগ পাকা বাড়ি।
কিন্তু এই গ্রামের যে আসল চমক সেটি হচ্ছে এখানকার প্রতি ঘরে ঘরে তৈরি হওয়া মাটির নানান জিনিসের। যেমন মাটির পুতুল, থালা, বাটি, ফুলদানি, মাটির প্রদীপ, ধুনুচি, মাটির ভাঁড় এছারাও আরও কতকি। এই গ্রাম মাটির গ্রাম নামেও খ্যাত। কারণ এখানে প্রায় বসবাস করেন ৫০০টি পরিবার। এবং এনারা সবাই মাটির কাজের সাথে যুক্ত। যে সমস্ত প্রদীপ বা হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী ব্যবহার হয়। সেই সমস্ত জিনিসগুলি তৈরি হয় কোন এক অন্য ধর্মের হাত ধরেও।
এই গ্রামের বাসিন্দা বছর ৬২’র আলতাব সেখ জানান, ‘আজ আমার প্রায় ৫০ বছর হতে চলল এই কাজের সাথে জড়িত। এই হাত কত কিছুই না বানিয়েছে। কখনও মাটির প্রদীপ কখনও বা মাটির থালা। দিনে প্রায় ২০০-৩০০টি করে মাটির প্রদীপ আমরা বানিয়ে ফেলি। এবং কমবেশি ২ টাকা করে প্রতি প্রদীপ পায়। এছারাও অন্যান্য জিনিস বানায় সেখানেও একটু উপার্জন হয়ে যায়। যেহেতু ছোট থেকে অন্যকোন কাজ শেখা হয়নি। তাই এই কাজের সাথেই নিজেকে জুড়ে থাকতে হবে।” এমনই নানান গল্প লুকিয়ে রয়েছে এই গ্রামের আনাচে-কানাচে। এখানে সম্প্রীতির ভেদাভেদ দেখা যায়না।
মাটির পুতুল এবং মাটির জিনিসের পাশাপাশি এই গ্রাম আরও একটি কারণের জন্যে বিখ্যাত। সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নানান মসজিদে মিনার বানিয়ে থাকেন এই গ্রামের শিল্পীরা। এই মিনার বানানোর ইতিহাসও কিন্তু সুপ্রাচীন। প্রাচীন বাংলার রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ রয়েছে। যেটি এই গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার আগেই। সেখানেই ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া যায় মাটির পুতুল এবং সেখানেই মসজিদের মাথার কালো মিনারও পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই গ্রামের তৈরি করা মিনারের ইতিহাস সুপ্রাচীন। এবং তখন থেকেই অবিকল এই মিনার তৈরি হয়ে আসছে।
যে কটি পরিবার রয়েছে তাঁদের মধ্যে সবাই এই মিনার বানানোর কাজের সাথে যুক্ত নন। বর্তমানে যিনি এখনও এই কাজের সাথে জড়িত তিনি হলেন প্রবীণ মৃৎশিল্পী সাধন পাল। তিনি জানান, ‘মুর্শিদাবাদে বহু ধর্মীয় মানুষের বসবাস। ফলে এখানে যত মসজিদ রয়েছে। তার ওপর কালো রঙের যে মিনার রয়েছে। তা সমস্তটাই তৈরি হয় এই কাঁঠালিয়া গ্রামে। সচারাচর দুই ধরনের মিনার এখানে বানানো হয় এক সোনালি রঙের এবং কালো। সোনালি ব্যবহৃত হয় মন্দিরের ক্ষেত্রে।’
প্রায় ১৩০০ বছরের ইতিহাস এখনও বহমান কাঁঠালিয়ার এই গ্রামের শিল্পিদের হাতে। ভারতের যেকোনো মসজিদে যদি কালো রঙের মিনার দেখতে পাওয়া যায় সেটি এই কাঁঠালিয়ার গ্রামের শিল্পিদের হাতে বানানো, এমনই দাবি করেন প্রবীণ শিল্পী সাধন পাল।
সারা ভারতের নানা প্রান্তের মসজিদে এই মিনারগুলো লাগানো হয়, এমনকি বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানেও পাড়ি দিচ্ছে এই মিনার। কাঁঠালিয়ার বাইরে অনেক জায়গার মৃৎশিল্পীরাই বিকল্প মিনার তৈরি করার চেষ্টা করেছেন বটে, কিন্তু কেউই সফল হননি। এর ফলে সারা, ভারতের যে কোনো অঞ্চলের মসজিদে যদি কালো মিনার দেখা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, সেই মিনার তৈরি হয়েছে কাঁঠালিয়াতেই। তাছাড়া, এই ধরনের মিনারগুলো কবরস্থান, মাদ্রাসা, ইদগা কিংবা বাড়ির গেট সাজাতেও অনেকে ব্যবহার করে থাকেন। আবার বেশ কিছু হিন্দু মন্দিরেও চূড়াতেও এখানকার মিনার লাগানো হয়। মসজিদের মিনারগুলোর ওপরে থাকে গম্বুজের মতো ছুঁচলো অংশ। আর মন্দিরের মিনারগুলো হয় লাল রঙের, তাদের আগায় ঘটের মতো কারুকার্য থাকে, ঘটের ওপর বসানো হয় ত্রিশূল। অবশ্য লাল মিনার নিয়ে গিয়ে একেক মন্দিরে বসানোর সময়ে একেক রকম রং করে নেয় লোকজন। কোনোটা সোনালি রঙের তো কোনোটা রুপোলি, আবার কেউ লাল রংটাকেই রেখে দেন।