ঋত্বিক দেবনাথ, বহরমপুরঃ হ্যাট হ্যাট, হুট হুট। এই রকম শব্দ শোনা মাত্রই আমরা সাধারণ শ্রোতাদের মাথায় যেটা আসে। সেটি হল কেও গরু-ছাগল বা এই জাতীয় পশুদের ব্যস্ত রাস্তার মধ্যদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী হবে যখন আপনি ঘুরে তাকাবেন আর দেখতে পাবেন এটি গরু-ছাগল না আস্ত ১০ ফুট লম্বা এবং ৮ ফুট মতন চওড়া, হলদেটে রঙের লম্বা গলার একটি জীব আপনার দিকে হনহনিয়ে হেঁটে আসছে। দেখে চেনা চেনা লাগবে কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখবেন সরসরিয়ে আপনার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে রাজস্থানের সম্মানীয় পশু উট।
হ্যাঁ! বহরমপুরের রাজপথে এমন দৃশ্য প্রায়শই চোখে পরছে। এই উট দেখতে হলে আগে শহরবাসীকে দৌড়ে যেতে হত গরমের দেশ রাজস্থানে কিংবা কোন চিড়িয়াখানাতে। কিন্তু বেশকিছু মাস ধরেই শহর তথা সমস্ত জেলাতেই দেখা মিলছে এই মরুভূমির রাজাকে। প্রশ্ন উঠতেই পারে কোথা থেকে আসছে এবং যাচ্ছেই বা কোথায়। উত্তরের খোঁজে দেখা মিলল বছর ৬৫’র সেলিম আলির সাথে। তিনি জানান, “রাজস্থানের জয়পুর থেকে বেশিরভাগ এইসব উট আসে। মঙ্গলবার এক ভ্যানে মোট ১২টি উট এসে পৌঁছেছে। এবং ধীরে ধীরে চলেও যাচ্ছে।”
প্রসঙ্গ ক্রমে জানা যাচ্ছে, কান্দি মহকুমার অন্তর্গত মহলন্দি গ্রামে থেকে এই উটের ব্যবসা চলে। কিছু সংখ্যক মানুষ এই উট কেনা এবং বিক্রি করা নিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। প্রায় ১৭২২ কিলোমিটার পথ অতিক্রান্ত করে এই উটগুলি আসছে। এবং সেখান থেকে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। সর্বনিম্ন ১ লক্ষ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দাম ওঠে এই সমস্ত উটদের। তারপর আবার চরা দামে বিক্রি করা হয় জেলার মানুষদের।
এবার আসল প্রশ্ন এই উটগুলির সাথে মানুষ করছেটা কী? উত্তরে ইসলামপুরের এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “এই উট কেনা হচ্ছে মাংস খাওয়ার জন্যে। এক সপ্তাহ আগে থেকে গ্রামে গ্রামে মাইকিং করা হয়। যারা কিনতে চান তাঁরা সবাই সারা সপ্তাহ জুড়ে অর্ডার দেয়, এবং তারপর সেই মতন উট কেনা হয়ে থাকে।” সাধারণত ৪০০-৮০০ টাকা প্রতি কেজি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে উটের মাংস।
কিন্তু এখানেই শেষ হচ্ছে না এই উটের যাত্রা। রাস্তায় যে সেলিম আলির সাথে দেখা হল, সে মহলন্দি থেকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে এই উট নিয়ে যাচ্ছে অন্তিম গন্তব্যে। প্রায় ৬০ কিলোমিটারের ওপর এই হাঁটা। এবং তার বিনিময়ে তিনি পাচ্ছেন কেবল ১৫০০ টাকা। মাঝরাতে বেড়িয়ে আসা বছর ৬৫’র সেলিম আলি হাজার প্রতিকূলতা কাটিয়ে মস্ত বড় জীবটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের রোজগারের জন্যে।
উনি জানান, “আমার অনেক বয়স হয়েছে। কেও এখন অন্য কাজ দেবেনা। এবং আমি প্রথম থেকেই এই গরু-ছাগল সামালাচ্ছি তাই আমার অভ্যেস আছে। অনেক সময় হয় হাত কেটে যায় পা কেটে যায়। মাঝে মাঝে রাস্তায় দাড়িয়ে আরামও করতে হয়। এবং সবচেয়ে বড় ব্যপার, এত বড় একটা প্রাণীকে দেখে মানুষ সামনে আসে ছবি তোলার জন্যে এবং সেখানেই ভয় থাকে এত বড় প্রাণীর পাগলামো করার। এত বড় বড় বাস-লড়ি যায় পাশ দিয়ে তখন যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেই সমস্ত দিক দেখে আমাকে নিয়ে যেতে হয়।” এমনই প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে মাসে ৫/৬ বার এই রাস্তা ধরে হেঁটে উটগুলিকে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিচ্ছেন সেলিম আলির মতন লোকেরা। কিন্তু প্রশ্ন একটাই পেটের খিদে এবং জিবের স্বাদ মেটানোর জন্যে এত বড় বড় জীব হত্যা হচ্ছে তা কতটা আইন সম্মত এবং পাশপাশি এত বড় বড় পশু প্রশাসনের চোখের আড়ালে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। প্রশ্ন এখানেই কীভাবে তারা এই কাজ করতে পারছেন।