লকডাউনে ঘরে ফেরা পরিযায়ী তাহাবুল সস্ত্রীক এবারের হাইমাদ্রাসার পরীক্ষার্থী

Published By: Madhyabanga News | Published On:

বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ কথায় আছে সাগর যা নেয় তা ফিরিয়ে দেয়। লকডাউনও যে জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে কে জানত? করোনার দাপটে ভূ-ভারত যখন শুনশান, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ির দিকে যখন এগিয়ে আসছে শ্রমিক সেই দিনগুলো কেমন ছিল, ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছেন অনেকেই। বছর আটত্রিশের যুবক তাহাবুল শেখের জীবনও আচমকা বাঁক নিয়েছিল। সংসারের মানুষগুলোকে দু-মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার তাগিদে তাহাবুল যখন বাড়ি ছেড়েছিলেন তখন তিনি নাবালক। তকিপুর হাইমাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া সে। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট তখনও বেড়োয়নি। পিছনে বইয়ের ব্যাগ ফেলে ট্রেনে চেপে ছিলেন রেজিনগরের বাসিন্দা তাহাবুল অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে। এক গাঁয়েরই ‘চাচা’ বলেছিল, “বেড়িয়ে পর। কিছু না কিছু কাজ ঠিক জুটে যাবে। বেড়িয়ে পর।“

সেদিন বাবা, মাকে গাঁয়ে রেখে, খেলার মাঠ, বন্ধু-বান্ধব সর্বোপরি কিশোর বেলাকে অতীত করে ট্রেন থেকে নামলেন কলকাতায়। কিন্তু এত বড় শহরে কী কাজ সে করবে? কোন দক্ষতা তার আছে? কীভাবে নিজেরই পেটের খিদে মেটাবে সে? অগোছালো প্রশ্ন গুলো তখনও মনের মধ্যে গেঁথে উঠতে পারে নি তাহাবুলের। কিন্তু শূন্যতা তো ছিলই। প্রতিবেশী যে দু-চার জনের সঙ্গে কলকাতা গেলেন তাঁদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কাজ খুঁজতে লাগলেন। কাজ পেলেন না, কিন্তু সময়ও  নষ্ট করলেন না। শিখলেন বড় লোকের ঘর ঠান্ডা রাখার এসি মেশিন কীভাবে সার্ভিসিং করতে হয়। কাজটা পছন্দ হল। শিখতে শিখতে যেদিন কাজের সন্ধান এল সেদিন ঠিকানা বদলেরও চিঠি এল। কলকাতাকে পিছনে ফেলে পাড়ি জমালেন মুম্বইতে। থাকা খাওয়া ছাড়া এসি সার্ভিসিং করে মাস ফুরোলে মিলবে আঠারোশো টাকা। শুরু হল রোজ নামচার জীবন। পথে ঘাটেই রেজিনগরের তাহাবুল সাবালক থেকে জওয়ান হল। বাড়ি ফিরে পরিচিত আসমাকে জীবন সঙ্গী করে যখন ফের ভিন দেশে হাজির হলেন রোজগার তখন তিন অঙ্ক ছুঁয়েছে। সেটা তাও ২০০৭-০৮ সালের কথা। আসমার হাত ধরে তারপরেও কেটে গিয়েছে বছর বারো তেরো।

২০২০ সালের প্রায় শুরুতেই হঠাৎ টালমাটাল বিশ্ব। লকডাউনের ধাক্কায় বেসামাল জনজীবন। সেই ধাক্কার ঢেউ লাগল তাহাবুলের জীবনেও। মুম্বইয়ের পাট চুকিয়ে চলে এলেন ভিটে বাড়িতে। এরমধ্যে দুই ছেলেও বেড়ে উঠছে। স্কুলে ভর্তি হয়েছে। কোথাও মাটি কাটা কিংবা অন্যের জমিতে চাষ করার ফাঁকে নিজের একটুকরো জমি নিড়োতেও হচ্ছে নিয়ম করে। সময় গিয়েছে। মুখে মাস্ক আঁটা জীবন থেকে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে চারপাশ। এমন সময় কী মনে হল তাহাবুলের। একবার ফেলে আসা কিশোর বেলায় ফেরা যায় না? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ছুটে চলে গেলেন সেই আগের মতো যেমন যেতেন স্কুলে। ফারাক বলতে সেই সময় বই বগলে নিয়ে যারা তাঁর সঙ্গে স্কুলে যেতেন সেই সহপাঠিরা আজ তার পাশে নেই। পাশে আছে দুই ছেলে। তকিপুর হাইমাদ্রাসায় গিয়ে স্যারদের মনের ইচ্ছে কথা জানালেন। নথি ঘেঁটে স্কুলের শিক্ষকরা জানিয়ে দিলেন, চল্লিশ ছুঁইছুঁই তাহাবুলের মাদ্রাসা পরীক্ষায় বসতে কোনও বাধা নেই। আর কিছু ভাবলেন না। বাড়ি ফিরে আসমাকে জানালেন। তাঁকেও ফের পড়াশোনার জীবনে ফিরতে উৎসাহ দিলেন।

জুটিতে ভর্তি হলেন নবম শ্রেণিতে। এবার যুগলেই হাইমাদ্রাসার সিনিয়র পরীক্ষার্থী। এদিন হাসতে হাসতে বললেন, “ কম লেখাপড়া জানায় বিদেশ বিভুঁইয়ে পদে পদে ঠোক্কর খেতে হয়েছে। মনে হয়েছে জীবনের অঙ্কে পাঠ্য বইয়ের অঙ্কের সরাসরি যোগ হয়ত নেই। তবু অঙ্ক কষেই পা  ফেলতে হয়। তাই ফিরে এসেছিলাম স্কুলের ঘরবারান্দায়।” তাহাবুলের পাশে দাঁড়িয়ে আসমা বললেন, “ ছেলেদের একজন সিক্সে আর একজন সেভেনে পরে। ওদের যদি ভুল ধরিয়ে দিতে পারি মা হিসেবে তার থেকে গর্বের আর কী আছে? তাই ফের বইয়ের পাতা ওল্টাতে এলাম তাহাবুলের ভরসায়।” ওই স্কুলের শিক্ষক হাসিবুর রহমান, মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের জেলা মনিটরিং টিমের সদস্য মনিরুদ্দিন খান সহ অন্যরা বললেন, “ মনের ইচ্ছের কাছে বাকি সবই তুচ্ছ, তাহাবুল প্রমাণ করলেন।” তাহাবুল ও আসমা পাশ করবার ব্যপারে একশো  শতাংশ নিশ্চিত। পড়ালেখার অলিন্দে আরও একটু এগোনোর ইচ্ছে রয়েছে আসমার। বললেন, “পরিকল্পনা করে কী জীবন এগোয়? সময়ের উপরেই রয়েছে জীবনের ভার। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়ত মিলবেই। দেখা যাক।”