প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের পরিচালনায় ইউটিউব চ্যানেল উরিবাবা (Uribaba) স্ট্রিম করছে আউট এন্ড আউট বাংলা ওয়েবসিরিজ ‘বিরহী’। ওটিটি বা ওয়েব ব্যাপারখানা খুব পুরোনো না হলেও, ভিডিওর দুনিয়ায় সিরিজ বা সিরিয়ালের প্রচলন সেই মহাভারতের যুগেরও আগে থেকে। হ্যাঁ, টিভি এখন মোবাইল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু টিভির দর্শক যে খুব একটা ঝারা হাত পা, ছবিটা এরকমও নয়। তাই টিভি চ্যানেলের দৈনিক বা সাপ্তাহিক বাজারি ভিডিও, এপিসোডভিত্তিক রিয়্যালিটি ড্রামার যুগেও যদি ইউটিউব চ্যানেলে বিনিপয়সায়, শুধুমাত্র সাবস্ক্রিপ্সনের অছিলায় একটা নির্ভেজাল ভালো বাংলা গল্প দেখতে পাওয়া যায় তাহলে সেটা বাঙালি দর্শকের জন্য খুবই ভালো অফার বটে। গল্পটা স্ট্রিম করছে ‘উরিবাবা’র ইউটিউব চ্যানেলে। এখনও পর্যন্ত তিনটে এপিসোড রিলিজ করেছে, আরও অনেক কিছু বাকি আছে, যা ট্রেলার দেখলেই বোঝা যায়।
যেটার কথা বলব বলে প্রথম থেকেই ভেবে রেখেছিলাম সেইটে হল সাত্যকি ব্যানার্জির আশ্চর্য গায়কী, শুধু গায়কী বললে ভুল হবে, এই গোটা সিরিজে যে আবহনির্মাণ করেছেন সাত্যকি, তাই সম্ভবত এই সিরিজের প্রধান ইউ এস পি।
এবার আসি গল্পে, না গল্প বলব না। গল্প আসলে বলা যায় না, দেখতে হয়, দেখতেই হয় কেবল। ‘বিরহী’ ― যা কিনা এই সিরিজের টাইটেল ― আসলে একটা স্টেশন, স্টপেজ, রুট, জায়গা, স্থান, গ্রাম, পঞ্চায়েত, প্রাইমারি স্কুল, সেবাকেন্দ্র, আড্ডার ঠেক… ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও বাংলা অর্থকোষে ‘বিরহী’ মানে বিরহ যার সঙ্গী। জীবনের সঙ্গে সেই বিরহ আমাদের সবার মতো এ গল্পের চরিত্রদেরও আছে। এই গল্প এসে পড়েছে ‘বিরহী প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এ, এখানে আসার পথ দুর্গম, অনেক কসরত করতে হয় বিরহী পৌঁছোতে। এক অর্থে বিরহীই হচ্ছে এই গল্পের হিরো, বলতে পারি।
যাঁরা এই সিরিজের পরিচালক সম্পর্কে একটুকু জানেন তাঁরা একথা নিশ্চয় জানেন এবং একমত হতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না যে, বিরহী আসলে আমাদের ‘মোহিনী’র কথা মনে করায়। যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্যে বলে রাখি, মোহিনীও এক গ্রামের নাম। সেই গ্রাম নিয়ে এই পরিচালকেরই একটি ছবি আছে, ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ তার নাম, সেটিও এমনকী এই ইউটিউবের ভিতরেই আছে, খুঁজলেই মিলবে। ছবিটা মিলবে, কিন্তু ‘মোহিনী’ মিলবে না। এই সিরিজের পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য আরও খান পাঁচেক ফিচার ফিল্ম ও বেশ কিছু শর্ট ফিল্ম বানিয়ে ফেলেছেন ইতিমধ্যে, যা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে আলচনাযোগ্য ― এ কথা এখন স্বতঃসিদ্ধ। ওঁর ফিল্মের একটা বিশেষ ভাব আছে, যার মধ্যে মাথাচাড়া দেয় মফস্বল, বাংলাদেশের না দেখা বা কম দেখা উপেক্ষিত অঞ্চল ও তার লোকায়ত সংস্কৃতি (কীর্তন, বাউল গান থেকে হাঁপু গান)। এসবের মাঝে সিনেমাকে এনে ফেলা সিনেমা নামক শিল্পমাধ্যমটির সম্পর্কে ওঁর একান্ত নিজস্ব কমেন্ট। এই কাজটির ক্ষেত্রেও তা প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
গাঁয়ের ছেলে কৃষ্ণ দিনে ডালে উঠে নবদম্পতির বিয়ের ভিডিওর সেট ডিজাইন করত, রাতে টিউশনি। সে হঠাৎ পড়ানোর চাকরি পায় বিরহী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হ্যাঁ, এ বাজারেও চাকরী। ঠিক সেই সময়, যখন চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে জীবনের জটগুলো খুলবে বলে ভেবেছিল কৃষ্ণ, তখনই জড়িয়ে পড়ে বিরহের জালে, কারণ চাকরি তো বিরহীতে। বিরহীতে প্রথমদিন কাজের অভিজ্ঞতায় ট্রান্সফারের দিকে ঝুঁকে পড়ে আমাদের কৃষ্ণ। কিন্তু চাকরি পাওয়া ততটা কঠিন নয়, যতটা কঠিন বিরহী থেকে ট্রান্সফার নেওয়া। একবার বিরহীতে ঢুকলে নিস্তার নেই, জীবনের পঙ্কিল সত্যকে স্বীকার করে নিবস্ত্র হয়ে শুদ্ধিকরণের পর বিরহীতে ঢুকতে হয়। তারপর সামনে আসে বিরহীর লোকজন, তাদের সহাবস্থান প্লটকে ঘনিয়ে তুলতে থাকে। গল্প এখনও অনেক বাকি, শুধুমাত্র তিনটে এপিসোড বাজারে এসেছে। প্রতি শুক্রবার ‘উরিবাবা’র চ্যানেলে আসছে বিরহী।
শেষ আপডেট হিসেবে এটুকু বলতে পারি ― ‘রাধাকুণ্ডে মারো ডুব, শ্যামকুণ্ডে ওঠ রে’। ‘বিরহী’তে কৃষ্ণ তো ছিলই প্রথম এপিসোড থেকে, এবার লেটেস্ট এপিসোডে রাধার আগমন আগামী এপিসোডের জন্য উতলা করে দিল। ভালো সিরিজের এটাই গুণ। সিরিজের ক্ষেত্রে গল্প কেমন নিপুনভাবে বলা হচ্ছে, কিভাবে এপিসোড অনুযায়ী কেটে ভাগ করা হচ্ছে যাতে করে সিরিজের পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখতে পারে ― সেটা মাথায় রেখেই এই সিরিজের চলন, এখন ওয়েবের যুগে এই চলনই মূল বিষয়। বিরহীর মধ্যে সেই চলন দেখা যায়, যা একটা ভালো ওয়েব সিরিয়ালের থেকে কাম্য। বিরহী এখনও শেষ হয়নি, বিরহীর সাথে থাকুন।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)