রাহি মিত্রঃ বহরমপুরঃ আশ্বিনের শারদ প্রাতে নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ যেমন শারদ সমীরণে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আরো একটি গন্ধ কিন্তু মিশে থাকতো ফেলে আসা দিনগুলোতে । যদিও এখন আর পাওয়া যায় না সে গন্ধ । তা হল উমার বোধনের ঘট স্থাপনের সময় থেকেই বানানো শুরু হয়ে যাওয়া নাড়ু , মুড়ি , নিমকি, গজা, নারকেলের মিষ্টির সুবাস, আর নাড়ু বানানোর জন্য আখের গুড় পাক করবার সেই গন্ধ ।
সে এক দিন ছিল বটে ! সে সময়ের যৌথ পরিবার হোক বা না হোক , পুজোর নাড়ু মুড়ি-মুড়কি বানানো যেন বাড়ির অন্দরে আর এক উৎসব । আয়োজন আরম্বর যথেষ্ট বড় রকমের ছিল । পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা , ঠাকুমা দিদিমা পিসি মা জেঠিমারা মূল উদ্যোক্তা হলেও এ কাজে পরিবারের মেজ সেজ ছোটরা ও রীতিমতো ভাগ নিতো এর আয়োজনে । বাড়ির পুরুষ সদস্যদেরও একটা যোগদানের অংশ থাকতো তাতে । যেটা খোসা সমেত নারকেলের খোসা গুলিকে দা অথবা হেসো দিয়ে ছাড়ানো ছোবড়া গুলো আবার যত্নে রেখে দেওয়া পরে ধোয়ার দেওয়ার কাজে লাাগানোর জন্য । উপকরণ হিসেবে যা যা থাকতো তার মধ্যে আখের গুড় ছিল প্রধান । বংলার পল্লীতে পল্লীতে আখ কেটে কেটে রস বার করে জ্বাল দিয়ে হত গুড়। শীতের শেষদিকে মাঘ ফাল্গুন মাসে উঠত নতুন আখের গুড় । যে গুড় কাজে লাগত নাড়ু তৈরির তে শারদ উৎসবে । তবে এই নাড়ু মূড়কি তৈরির বৈচিত্র বেশি দেখা যেত পূর্ববঙ্গে । পশ্চিমবঙ্গেও পুজোর নাড়ু মুড়কির আয়োজন আরম্ভর ছিল বেশ ভালোই । আর যা চলত দূর্গা পূজার পর লক্ষ্মীপুজো পার করে দীপাবলি কালী পুজো পর্যন্ত ।
তবে একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলতেই হবে যে, বাংলার ঘরে ঘরে এই প্রথা ব্যাপক অর্থে সারা ফেলত । পুজোর নাড়ু মুড়কি মুড়ি কেবল যে পরিবারের লোকজনের জন্য বানানো হতো তা তো নয় । পরিবার ছাড়িয়ে পাড়া-প্রতিবেশী , কাছের আত্মীয় ছাড়িয়ে দূরের আত্মীয়দের বাড়িতেও পাঠানো হতো হাতে তৈরি নাড়ু মুড়ি নিমকি গজা । এছাড়াও পাড়া বা বেপাড়ার পুজোর শেষে ঢাকিরা আসতেন বাড়ির দরজায় দরজায় । ঢাক বাজিয়ে চাইতেন নাড়ু মুড়ি-মুড়কি। আসতেন ধাই মা রা । প্রসূতি মায়েদের প্রসব করিয়ে ধাইমা বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন যাঁরা গ্রামাঞচলে । তাঁরাও আসতেন ঘামা হাতে । বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিতেন নাড়ু মুড়ি-মুড়কি নিমকি ইত্যাদি খাবার-দাবার । অনেক পাড়াতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ও আসতো দলবেঁধে , ” নাড়ু মুড়ি দেন গো বলে ” ।
সে এক উৎসবের অঙ্গ হিসেবে আরও এক উৎসব ছিল । অবশ্য এসবই হতো এক আন্তরিকতা মেশানো ছন্দে বলা যায় । এর মধ্যে সাবেকি সুর তো ছিলই৷, ছিল এক অমলিন নিবিড় আন্তরিকতা যাতে কেউ সংকোচ বা ইতঃস্তত বোধ করতেন না কারোর বাড়ি গিয়ে নাড়ু মুড়ি সংগ্রহ করতে বা খেতে । বলা যায় সর্বজনীন দুর্গাপুজো তে এ ও এক সর্বজনীন প্রথা। পুজোর আনন্দ যেমন নতুন জামা পড়ে সাজগোজ করে মন্ডপে মন্ডপে ঠাকুর দেখতে যাওয়া ঘুরতে বেড়াতে যাওয়া তে , তেমনি পুজো শেষে বিজয়া করতে গিয়ে প্রণাম করে নাড়ু মুড়ি-মুড়কি নিমকি গজা খাওয়াতে । আনন্দ কে সমাজের সব স্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার এই প্রথা আধুনিকতার ধারে কাছে না থাকলেও আন্তরিকতা তে পরিপূর্ণতা বলতে কোনো দ্বিধা থাকে না।
তবে আধুনিকতার কথা যখন এলোই তখন বলতেই হবে যুগের ধর্ম যেমন পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া , তেমন এই মেনে নেওয়া কে মেনে নিয়ে কিন্তু অবলুপ্তির পথে শেষ সীমায় চলে গিয়েছে আজ আশ্বিনের শারদপ্রাতে বাতাসে আখের গুড় পাক করার গন্ধ আর নারকেলের নাড়ু বানানো থেকে খইয়ের মুড়কি ময়দা দিয়ে বানানো নিমকি থেকে নারকেল ছিঁড়ে বা আর সব নাড়ু বানানো । যুগধর্ম বলা যায় সব শশব্যস্ত সদা ব্যস্ত জীবন ছকে আজ সময়ের বড় অভাব । অভাব উদ্যোগেেরও । তাই আজ শহরের মিষ্টির দোকানগুলোতে বা কনফেকশনারী গুলিতে কাচের শোকে শোকেস ঝকঝকে মোড়কে বিক্রি হচ্ছে নারকেলের নাড়ু কুচো নিমকি থেকে খইয়ের মুড়কি তিলের নাড়ু চিড়ের নাড়ু এইসব।
এই পরিবর্তনের সময় সন্ধিক্ষণে শহর বহরমপুরের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ জানালেন আশ্বিনের শারদ বেলায় তাঁদের সেই সব দিনের নাড়ু মুড়ি-মুড়কি তৈরিকে কেন্দ্র করে আরও এক উৎসবের দিনের সুখস্মৃতি।
মৃণালকান্তি চক্রবর্তী , যিনি বহরমপুর কলেজের প্রাকতন অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ , জানালেন , তাঁদের সময়কার পুজো আর পুজোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ নাড়ু মুড়ি-মুড়কি গজা নিমকি বানানোর ধূম যৌথ পরিবার গুলিতে বা অন্যান্য পরিবার গুলিতেও । একই সাথে উৎসবের এই অঙ্গটির একটি সুন্দর এবং ইতিবাচক ভূমিকা ছিল সে সময়কার সমাজে। তাও জানালেন তিনি । ভূমিকা টি হল , আনন্দকে সর্বজনীন করে তোলা। পরিবার থেকে পাড়া দূরের আত্মীয় থেকে সমাজের অন্যান্য পেশায় যুক্ত মানুষদের উৎসবের সুরে মিলানোতে শামিল করে নেওয়া ।
পাশাপাশি শহরে একসময়ে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থাকা প্রবন্ধকার সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত আজও সেই আন্তরিকতার ছোঁয়া টা কে খুব মিস করেন । তেমনটাই জানালেন তিনি । তিনি যেন ফিরে গেলেন ছেলেবেলায় যেখানে নাড়ুতে মুড়কিতে নিমকি গজাতে থাকতো মা ঠাকুমা দের সেই হাতের ছোঁয়া আর আনতরিকতা যা আজকের মিষ্টির দোকান বা কনফেকশনারী সুদৃশ্য শোকেসে কখনোই পাওয়া যাবে না । কারন যেখানে আছে কেবল ব্যবসায়ীক চিন্তা-ভাবনা নেই মনের কোন যোগ।
তবে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা নিয়ে মতামত দিলেন প্রাবন্ধিক চন্দ্র প্রকাশ সরকার । সময়ের অভাব এখন , আর আগে ছিল অখন্ড অবসর । যার জেরেই ধীরে ধীরে কমতে কমতে বিলুপ্তির পথে আশ্বিনের শারদ প্রাতে উমার আগমনের সাথে সাথে নাড়ু মুড়ি-মুড়কি নিমকি গজারা । এছাড়াও রয়েছে দেশব্যাপী বাণিজ্যিককরনের প্রভাব। যার ফলে ব্যস্ততম লাইফস্টাইলে হাতের কাছে দোকানে যখন কচকে মোড়কে নাড়ু মুড়ি নিমকি আরও বহু কিছু লোভনীয় খাবার দাবার পেয়ে যাচ্ছে মানুষ তখন কেন আবার বাড়িতে এইসব ঝামেলা করা । এমনই একটি রেডিমেড ভাবনা চলে এসেছে।
তবে একথা সত্য যে যুগধর্মকে মেনে নিতেই হবে । ট্রেন্ড যখন যেমন তখন তেমন ভাবে চলাটাই তো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। আর যাঁরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে তারাই বুদ্ধিমান । তাই সেই সব দিনগুলি থাক স্মৃতির মণিকোঠায় সুরক্ষিত। আর যুগ ধর্ম মেনে চলি আমরা আগামীর পথে । কারণ সেই আগামী টাও তো একদিন একইভাবে ঠাঁই পাবে স্মৃতির মনিকোঠায় । চরৈবেতি ই তো জীবন ।