দেবনীল সরকারঃ রাত পোহালেই রাজ্যজুড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এক দফার এই নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েতের মানুষের অধিকার, তাঁদের দাবী নিয়ে জেলায় জেলায় গঠন হবে নতুন গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। মোড়াম রাস্তা ঢালাই হবে, মেরামতি হবে, গ্রামের মোড়ে বসবে জলের কল, ঘর হবে, মাথার ওপর বসবে ছাউনি, মাঠ ভরা ধান হবে, নিজের লোকের ঠোঁটে হাসি থাকবে- এই তো সামান্য চাওয়া। এতেও অশান্তি!
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই পঞ্চায়েত ভোটই হল গ্রামের মানুষের গণতন্ত্র উদযাপনের উৎসব। গত পাঁচ বছর আগে, ২০১৮ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় এক পেশে ভোট করে জেলা পরিষদ দখল করেছিল শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। তবে এবারের পঞ্চায়েত ভোটের আগে জেলার ছবি কী? তৃণমূল তো বটেই পাশাপাশি তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বাম-কংগ্রেস জোট, বিজেপিরও। তবে ভোটের এক হপ্তা আগেও যেভাবে রোজ জেলাজুড়ে আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা উদ্ধার হচ্ছে তাতে করে ভোটের আগে পঞ্চায়েতের মানুষ যে উদ্বিঘ্ন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারতীয় সংবিধানে বলা হয়, ভোট নাকি ‘গণতন্ত্র উদযাপনের উৎসব’। তবে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট উৎসবের আগে এরকম হিংসার কী মানে? এ কী নেহাতই গরিব অবুঝ প্রাণের বলি? রাজনীতি করার অপরাধ? নাকি প্রতিহিংসার আগুন? সাধারণ মানুষের ওপর কারা চাপিয়ে দিল এই প্রতিহিংসার অগ্নিবান? আদতেই উৎসব নাকি যুদ্ধের প্রস্তুতি? পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার পর রাজ্য তথা মুর্শিদাবাদ জেলার বিগত কয়েক দিনের ছবি থেকে এই সব প্রশ্নই উঠে আসছে বারবার।
রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকেই মুর্শিদাবাদ জেলার চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে হিংসার খবর উঠে এসেছে। রোজ লাগাতার উদ্ধার হয়েছে বোমা, আগ্নেয়াস্ত্র! পঞ্চায়েতে নির্বাচনে জেলার গ্রামে গ্রামে মজুত বোমা প্রকাশ্যে আসছে। বোমা বাঁধতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। চারিদিকে হিংসা হানাহানির খবর! ভোট আসতেই যেন জুজু বেরিয়ে পড়েছে। কার বা কাদের সুপারিশে এই বোমা বাঁধা হচ্ছে? হিংসার মাস্টারমাইন্ড কারা? গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে এত হিংসা! পঞ্চায়েত ভোটের নমিনেশন প্রক্রিয়া শুরু হতেই প্রথম দিনেই রক্ত ঝড়ল মুর্শিদাবাদে। খড়গ্রামের রতনপুরে ফুলচাদ সেখ নামে এক কংগ্রেস কর্মীকে গুলি করে খুনের অভিযোগ উঠেছিল শাসকদল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ঘটনায় দু’জন গ্রেফতারও হল। তারপর?
হিংসা কিন্তু থামল না লাগাতার রাণীনগর থেকে সাগরপাড়া, ভরতপুর থেকে দৌলতাবাদ, সামশেরগঞ্জ থেকে বেলডাঙ্গা, হরিহরপাড়া থেকে কান্দি, রঘুনাথগঞ্জ থেকে রেজিনগর, খড়গ্রাম থেকে সালার চারিদিক থেকে উদ্ধার হল বিপুল পরিমান আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা, বোমা তৈরির সরঞ্জাম। এ যেন রীতিমতো বোমার চাষ! বেলডাঙ্গাতে বোমা বাঁধতে গিয়ে মৃত্যু হল আলিম বিশ্বাসের। সকাল ৯টা, যখন সবাই কাজে যায়, তখন হঠাতই বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল বেলডাঙ্গা থানার মহ্যমপুর বাগানপাড়া এলাকা। বোমার আঘাতে ঝলসানো মৃতদেহ ও ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমান বোমা তৈরির মশলা-সরঞ্জাম উদ্ধার করল পুলিশ। নিজে নিজে তো আত্মঘাতী হননি আলিম, তা স্পষ্ট। তবে কেন, কার সুপারিশে বোমা বাঁধছিল সে? উত্তর মেলেনি, মিলবেও না। পঞ্চায়েত ভোটের বলি হল আরও এক। এভাবেই চলতে থাকল ঘটনার ঘনঘটা। উত্তর খুঁজতে গেলে শুনতে হবে এতো মুশিদাবাদ। পঞ্চায়েতে এরকম হিংসা তো হবারই কথা। এই কী তবে গণতন্ত্র? আর রক্তাক্ত নিথর প্রাণগুলি কী ভোট উৎসবের বলি বা কুরবানি? তৃণমূল বনাম বাম-কংগ্রেস বনাম বিজেপি এই সমীকরনে চলল ক্ষমতার হানাহানি। এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের বলি হয়েছে ১৮ টি প্রাণ। তারমধ্যে ৫ জনই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা।
ভোটে হিংসা হানাহানি থামল তো না বরং বেড়েই চলল। এর মাঝেই নির্বাচনের ঠিক আগের দিন জেলায় এলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ট্রেনে করে বহরমপুর স্টেশনে এসে পৌঁছলেন তিনি। পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে হিংসা হানাহানিতে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের পরিবারের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য নিয়ে জেলায় এলেন তিনি। গেলেন নবগ্রামের নিহত তৃণমূল অঞ্চল সভাপতি মোজাম্মেল সেখ ও খড়গ্রামে নিহত কংগ্রেস কর্মী ফুলচাঁদ সেখের বাড়ি। কথা বললেন তাঁদের পরিবারের সাথেও। সেই দিনই জেলায় আবারও পঞ্চায়েত নির্বাচনের বলি হল একজন। রানিনগর ১ নম্বর ব্লকের হেরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের রায়পুরে অরবিন্দ মণ্ডল নামের এক কংগ্রেস কর্মীকে পিটিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠল শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে। আহত অবস্থায় ওই কংগ্রেস কর্মীকে ইসলামপুর ব্লক হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
২০১৮ সালের দুঃসাহসিক পঞ্চায়েত অভিযানের পর আবার ২০২৩ এ পঞ্চায়েতে আবার ভোট দেবেন পঞ্চায়েতের মানুষ। মুর্শিদাবাদ জেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ৫১ লক্ষ ৪ হাজার ৩২৯ জন। যার মধ্যে ২৫ লক্ষ ৯৫ হাজার ২৬৭ জন পুরুষ, ২৫ লক্ষ ৮ হাজার ৯৬৮ জন মহিলা ও ৯৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৯৪ জন। আগামী ১১ ই জুলাই মঙ্গলবার ফলপ্রকাশ হবে পঞ্চায়েত ভোটের। এরপর বাকি কথা বলবে ‘সময়’।
রাত পোহালে ভোট শনিবার (৮ই জুলাই) সকাল সাতটা থেকেই শুরু হবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া। মুর্শিদাবাদের ২৬ টি ব্লকে একদফায় হবে নির্বাচন। পঞ্চায়েত ভোটে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের মোট আসন সংখ্যা ৭৮ টি, পঞ্চায়েত সমিতির আসন সংখ্যা ৭৪৮ টি। জেলায় মোট ৫৫৯৩ টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে রাজনৈতিক দলগুলি। জেলার ৩৫৫৪টি পোলিং বুথে গৃহীত হবে ভোট। পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য জেলায় ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রবেশ করেছে। জেলার বিভিন্ন স্পর্শকাতর এলাকাতে শুরু হয়েছে টহলদারীও। যদিও কিছু জায়গায় এখনও কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে উঠছে অভিযোগও। সব মিলিয়ে ভোটের আগের দিনও সরগরম মুর্শিদাবাদ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।