বেদান্ত চট্টোপাধ্যায়ঃ ভরসন্ধ্যায় হরদিন জমজমাট ঘুগনি দোকান। দোকান ঠিক নয়। আসলে একটা ঠেলা গাড়ি। ঠেলাগাড়ির সমান্যেই ভিড় জমছে প্রতিদিন। বহরমপুর কাশীশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাইরে ঘুগনি খেতে ভিড় করছেন আট থেকে আশি। নিরুপদ ধরের ঘুগনির স্বাদে মাতোয়ারা শহর ।
তবে নিরুর ঘুগনি বা নিরুপদ ধরের স্পেশাল ঘুগনি শুধু মাত্র টেস্টে নয়, আবেগেও যায়গা করে নিয়েছে অনেকের মনে। নিরুপদর ঘুগনি গল্প বলে প্রজন্মের পর প্রজন্মের।
বহরমপুর কাশীশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী রেশমা দাস স্কুল ছেড়েছেন অনেক বছর। কিন্তু ছাড়তে পারেন নি এই ঘুগনির মায়া। এখনো এই দোকানের নিয়মিত গ্রাহক । কথা বলতে বলতে উচ্ছ্বাসের সাথে বললেন “আগে স্কুলের ভিতর থেকে ১টাকা /২ টাকাতেও ঘুগনি খেয়েছি। এখন সময়ের তাগিদে দাম বেড়েছে কিন্তু স্বাদ একই। ছাত্র অবস্থায় খেয়েছি, আগে স্বামীর সাথে আসতাম এখন মেয়ে কে নিয়ে আসি । মেয়েও বন্ধুদের সাথে আসে |”
আসলে এই দোকানের মালিক ছিলেন নিরুপদ ধর। নিরুপদ ধরের মৃত্যুর পর দোকানে হাল ধরেছেন পুত্র বিশ্বজিৎ । নিরুর ঘুগনির স্বাদ গন্ধ একই ভাবে বজায় রেখে এখন দোকান সামলাচ্ছেন নিরু পুত্র বিশ্বজিৎ ধর।
১১ বছর বয়সে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে পড়তে পড়তেই সংসারে অভাবের তাড়নায় একটা বাচ্চা ছেলে ঠেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে ব্যবসা করার জন্য। প্রথমে শুধু পাওয়া যেত শুকনো ঘুগনি। তারপরে ধীরে ধীরে আইটেম বাড়তে থাকে।
শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ানো নিরুপদ ধরের ঘুগনির স্টলের স্থায়ী ঠিকানা হয় বহরমপুর বহরমপুর কাশীশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় ৪৭ বছর। পরবর্তীতে নিরুপদর হাত ধরেই ব্যবসার হাল ধরেন বিশ্বজিৎ ধর। বিশ্বজিৎ জানাচ্ছেন, “আজও যতটা পেরেছি বাবার সমস্ত ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছি । বাবা যে স্বাদ, যে ভালোবাসার স্পর্শে মানুষকে খাওয়াতেন সেইভাবেই মানুষকে খাওয়ানোর চেষ্টা করি ”
আজকের নিরুর ঘুগনি শুধু মাত্র স্বাদে ঘ্রাণে এক নয়। মিল আছে ট্রাডিশনেও। নিরুপদর মতোই বিশ্বজিৎ ধরও সপ্তাহে একদিন মৌন ব্রত পালন করেন । কোনো কথা না বলে ইশারাতেই সমস্ত কাজ হয় ঐ দিন। বাবার ধারা কে অক্ষুন্ন রেখে আজও ঠেলা গাড়িতে লম্ফো জ্বালিয়ে রাখেন বিশ্বজিৎ।
বিশ্বজিৎ জানাচ্ছেন “এই মৌন ব্রত একটা কঠিন অভ্যাস। বাবার থেকেই শেখা। কতজন সময়ে চেষ্টা করেছে কথা বলানোর, কিন্তু পারেনা! অনেক ধৈর্য আর মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।”
এই নিরুর ঘুগনি খেতে শুধু শহরের বাসিন্দা নয়, শহরের বাইরে থেকে, জেলার বাইরে আজও বহু মানুষ ভিড় জমান বহরমপুর গির্জার মোড়ে । জীবন্তি থেকে প্রায়ই বহরমপুরে কাজে আসেন হুমায়ুন কবির । বহরমপুর আসলেই এই দোকানের ঘুগনি না খেয়ে বহরমপুর ছাড়া হুমায়ুনের পক্ষে বেশ কষ্টের। হুমায়ূনের সুরে সুর মিলিয়ে পাশে বসে থাকা সুব্রত ধর বলেন, “নিরুদা যখন ছিল তখন থেকে এই দোকানে আসি, প্রায় সন্ধ্যায় এখানকার মটন ঘুগনি আমরা খাই। বাড়ির জন্য খাসির মাংসও নিয়ে যাই।”
এখন এই দোকানে পাওয়া যায় নর্মাল ঘুগনি, স্পেশাল মটন ঘুগনি, মেটে চচ্চড়ি, খাসির মাংস। আর দিনের বেলায় স্কুলের মেয়েদের জন্য মশলা মুড়ি, আচার আর নর্মাল ঘুগনি বিক্রি করেন বিশ্বজিৎ ধর। নিরুপদর উত্তরসূরি বিশ্বজিৎ ব্যবসা করতে করতে কবে যেন এই শহরের বন্ধু হয়ে গেছেন, বন্ধু হয়ে গেছেন শহরের মানুষের। চেনা অচেনা সকল গ্রাহকই তাঁর খুব আপন।
নিরুর ঘুগনি গল্প বলে প্রজন্মের পর প্রজন্মের। নিরুপদ’র ঘুগনি সাক্ষী রয়েছে পুরোনো বহরমপুরের পাল্টে যাওয়ার। শহর থেকে হারিয়ে গিয়েছে মোহন সিনেমা, কল্পনা সিনেমা। শহরের মায়া নিয়ে টিকে আছে নিরুর ঘুগনি ।