শুভরাজ সরকার, নবগ্রামঃ মাদলের বোলে জানান দিচ্ছে ‘সহরায়’ এসেছে। সেজে উঠেছে গ্রামবাংলা। পৌষ মাসে সংক্রান্তির আগে উৎসবের মেজাজ নবগ্রামের নারায়ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বলারডাঙ্গা গ্রামের আদিবাসী পরিবারগুলিতে। পাঁচ দিনের পরবে প্রথম দিনটি হল ‘উম’ অর্থাৎ শুভ সূচনা। শুক্রবার সকালে প্রচলিত রীতি মেনে প্রকৃতির সমস্ত দেবতাকে তুষ্ট করতে নিবেদন করা হয় ‘গড়টেন্ডি’ অর্থাৎ মাটি বা ভূমি দেবতাকে।
নতুন কুলোর সাজে থাকে ধান ‘উখৌড়’-এ তৈরি আতপ চাল, সিঁদুর, শালপাতার ঠোলাই, কিছু মুরগি। প্রতিটি পরিবার থেকে দেওয়া অল্প চাল এবং চাল ও বাখরে মিশ্রিত তৈরি পবিত্র ‘হেন্ডি’। দেবতার উদ্দেশ্যে এই দ্রব্যগুলি উৎসর্গ করা হয়। মাঠে সামান্য একহাত বিশিষ্ট জায়গায় ঘাস পরিষ্কার করে পুজোর মণ্ডপ তৈরি করা হয়। সেই মণ্ডপটিকে বলা হয় ‘খটঁ’। সেখানেই মুরগি বলি দেওয়া রক্তের ফোঁটা মণ্ডপে দিয়ে, আতপ চাল সিঁদুর দিয়ে প্রাথমিক ভাবে ভূমি দেবতাসহ অন্য দেবতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। মাটির হাঁড়িতে রান্না হয় মহাপ্রসাদ। সেই প্রসাদ বিতরণ করা হয় গ্রামবাসীদের মধ্যে।
বিকেলে গ্রামের সব গরু ও মোষকে এক সঙ্গে মণ্ডপে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষে গড়টেন্ডি থেকে মোড়ল গোষ্ঠী আর গ্রামবাসী মাদল ও নাগরা বাজিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন। আদিবাসীদের সব থেকে বড় উৎসব এই সহরায়। উৎসবে সামিল হয়েছে গ্রামের সকলেই। আগামী ৫ দিন এই উৎসবকে ঘিরে বাড়িতে আসেন অতিথিরাও। অনেকের মতে, সহরায় শব্দটি এসেছে ‘সহরাও’ থেকে। যার অর্থ সম্বর্ধনা বা প্রশংসা। গো-মহিষাদির দিয়ে আগামী ফসলের সম্ভাবনায় আনন্দ-উৎসব। আবার অনেকের মতে, ‘সহরায়’ এসেছে ‘সাহার’ শব্দ থেকে। সাহার শব্দের অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। অর্থাৎ ধন, জন, গরুর বৃদ্ধি কামনায় এই উৎসব। মূলত কৃষি প্রধান অঞ্চলের উৎসব সহরায়।
স্থানীয় বাসিন্দা তথা এলাকার একজন শিক্ষক সত্যেন মুর্মু জানান, “সাহরাই বা সহরাই সাঁওতাল সমাজের একটি শ্রেষ্ঠ উৎসব। যার প্রথম ভাগটি পুরোপুরি সাঁওতাল সংস্কৃতির প্রাচীন ধারা। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুড়মি এবং আহিরদের বাঁধনা পরবের অনুষঙ্গ-গো-বন্দনা’। তবে সহরায় পরব শুধু গো-বন্দনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। হয়ে ওঠে সামাজিক মিলন উৎসব। বাঙালির দুর্গোৎসবের মতো সাঁওতাল সমাজে সহরায়ের গুরুত্ব। এলাকার বিবাহিত মেয়েরা এইসময় ‘বাপের বাড়ি’ আসেন ক’দিনের জন্য। মিলিত হন বাল্যকালের সঙ্গীদের সঙ্গে। এই সময়ে গানে মুখরিত হয়ে উঠে সাঁওতাল পল্লি।”