দেবনীল সরকার, বহরমপুরঃ আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে মুর্শিদাবাদ জেলা বইমেলা। এই বইমেলা ঘিরে জেলাবাসীর উন্মাদনা থাকে তুঙ্গে। বছরের এই সময়ের অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকেন জেলার বইপ্রেমী মানুষ। মেলার সময়ে বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ারে ময়দানে উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়। সাত দিনের বইমেলায় প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষের আনাগোনা হয় এই বইমেলা চত্বরে। কয়েক কোটি টাকার বইও বিক্রি হয়েছে গত বছর বই মেলা থেকে, এমনটাই জেলা তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের খবর। এ কথাই প্রমান করে জেলার মানুষের বই প্রীতির কথা। বইপ্রেমী থেকে পাঠকের সংখ্যাটা বাড়ছেও। তবে জেলার পাঠাগার বা লাইব্রেরিগুলি কী অবস্থায়? উত্তরের খোঁজে যেতে হবে গোড়ার দিকে।
প্রাচীন এই জেলা। আরও প্রাচীন তার ইতিহাস। মুর্শিদাবাদ জেলা ও শহর বহরমপুরের ইতিহাসের সম্যক ছবি দেখলে প্রথমেই আসবে নবাবি আমল আর তারপরে ইংরেজ আমলের কথা। নবাবি আমলে নির্মিত এই জেলার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হাজারদুয়ারি। আর এই হাজারদুয়ারির প্যালেসে নির্মাণের প্রায় ২৭ বছর পরে ১৮৬৪ সালে তৈরি হয় জেলার প্রথম গ্রন্থাগার ‘নিজামত লাইব্রেরি’। সেই সময়ে নবাব ছিলেন ফেরাদুন জাঁ। পান্ডুলিপি সহ প্রায় ৮০০০ বইয়ের সম্ভার ছিল সেই সময়ে। ইংরাজি সহ আরবি, ফার্সি ও উর্দুভাষার দুষ্প্রাপ্য বই নথির পাশাপাশি ছিল দেশ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ম্যাগাজিনও। নবাবী আমলে এই লাইব্রেরিতে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। পরে সরকার এর নিয়ন্ত্রণ নিলেও এটি জনসাধারণের ব্যবহারের গ্রন্থাগার হয়নি কখনই। অনুমতি নিয়ে গবেষকরা ব্যবহার করতে পারতেন এই গ্রন্থাগার। প্রাচীনত্যের দিক থেকে দুই নম্বরে আসে ‘জেলা কালেক্টরেট লাইব্রেরি’। এই লাইব্রেরিতে প্রাচীন পুঁথি থেকে আইনি দলিল দস্তাবেজের বিপুল সম্ভার রয়েছে। সাধারণের পাঠের বই এখানে নেই বললেই চলে। মানচিত্র থেকে বই, পুঁথি সব মিলিয়ে এখানেও রয়েছে প্রায় হাজার পাঁচেক বই, যা গবেষণার কাজে লাগে।
নিজামত লাইব্রেরি বা জেলা কালেক্টরেট গ্রন্থাগার, কোনটাই সাধারণের পাঠাগার ছিল না। সাধারণ মানুষের বই পড়ার কথা ভেবে জেলায় প্রতিষ্ঠা হয় ‘গ্র্যান্টহল ক্লাব লাইব্রেরি’। যদিও গ্র্যান্টহল ক্লাব জেলায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৬৬ সালে। পরবর্তীতে ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ‘গ্র্যান্টহল লাইব্রেরি’। যদিও সেই সময়ে এই লাইব্রেরির অবস্থা ছিল খুব শোচনীয়। তবে স্বাধীনতার পরবর্তীতে, ১৯৪৭ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার শিক্ষিত, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের সহায়তায় লালগোলার যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়ের নামে এই লাইব্রেরি ‘যোগেন্দ্রনারায়ণ মিলনী’ নামে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়, বনবিহারী সেন, পন্ডিত গিরিজাশঙ্কর, মণীশ ঘটক, ডা. শৈলেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সহ জেলার বিশিষ্টজনের থেকে বহু মূল্যবান বই, আসবাব ও অর্থ সাহায্যে পেয়ে নতুনভাবে সেজে ওঠে এই গ্রন্থাগার। বর্তমানে এই গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যাও প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি।
এরপরে দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের পরে ১৯৫৬ সালে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়, ‘মুর্শিদাবাদ জেলা গ্রন্থাগার’। শুরুতে এই গ্রন্থাগারের নাম ছিল ‘মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র জেলা গ্রন্থাগার’। প্রথমে এই গ্রন্থাগার বর্তমান ব্যারাক স্কোয়ারের পশ্চিম প্রান্তে ছিল না। প্রতিষ্ঠাকালে বহরমপুর শহরের উত্তরে সৈদাবাদে মহারাজা নন্দীর বাসভবনে প্রতিষ্ঠা হয় জেলা গ্রন্থাগারের। সেই সময়ে হাজার খানেক মূল্যবান বইও রাজপরিবারের তরফে দান করা হয়। শুরুতে প্রায় ১৫ হাজার বই ছিল। পরে এই গ্রন্থাগার নাম ও স্থান উভয়ই পরিবর্তন করে নতুনভাবে স্থাপিত হয় ব্যারাক স্কোয়ারের পশ্চিম পাড়ে। নাম হয় ‘মুর্শিদাবাদ জেলা গ্রন্থাগার’। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার বই আছে এই লাইব্রেরিতে। জেলার মানুষের বই পড়ার অভ্যাসের কথা ও প্রত্যেকের বই পড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে জেলার দিকে দিকে প্রতিষ্ঠা হয় অনেক লাইব্রেরি। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলায় রয়েছে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১৬৮ টি সরকারি গ্রন্থাগার। একটি জেলা গ্রন্থাগারের পাশাপাশি রয়েছে আটটি মহকুমা গ্রন্থাগার ও ১৫৯ টি গ্রামীণ গ্রন্থাগার। যার মধ্যে বহরমপুরে ব্লকে রয়েছে ৩১ টি গ্রন্থাগার। জেলায় একসময়ে ছিল গ্রন্থাগারের অভাব। পরবর্তীতে তৈরি হল ব্লক স্তরে অনেকগুলি গ্রন্থাগার। কিন্তু তারপর? নেই নিয়মকানুন রক্ষণাবেক্ষণের বালাই।
সবথেকে আশঙ্কার ছবি, মুর্শিদাবাদ জেলা গ্রন্থাগার ঘিরে। এই জেলা গ্রন্থাগারে নেই কোনও স্থায়ী গ্রন্থাগারিক। কীসের উদাসীনতায়? আছে প্রশ্ন, তবে নেই উত্তর। নেই নতুন গ্রন্থাগারিক নিয়োগ। বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলা গ্রন্থাগারেই সাতজনের শূন্যপদ রয়েছে। নেই স্থায়ী গ্রন্থাগারিক, সহায়ক, সহকারী কেউই। এমনকি পিয়ন থেকে দারোয়ান সকলেই অস্থায়ী। জেলা গ্রন্থাগারেই যদি এই ছবি হয় বাকি গ্রন্থাগারগুলির অবস্থা আরও শোচনীয় তা বোঝাই যায়।
পশ্চিমবঙ্গ সাধারণের গ্রন্থাগার কর্মী সংগঠনের, মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক সৌগত দাস জানান, জেলা গ্রন্থাগারের পাশাপাশি শোচনীয় অবস্থা মহকুমা ও গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলিরও। জেলায় রয়েছে আটটি মহকুমা গ্রন্থাগার। সেখানেও নেই স্থায়ী কর্মী। লাইব্রেরি চালান অস্থায়ী কর্মীরাই। ফলে জেলার লাইব্রেরিগুলিতে যে অচলাবস্থা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মহকুমা গ্রন্থাগারগুলিতেও রয়েছে প্রায় ৩৪ টি শূন্যপদ। একই ছবি গ্রামের লাইব্রেরিগুলিতেও। জেলায় বর্তমানে ১৫৯ টি গ্রামীণ লাইব্রেরিতে গ্রন্থাগারিক ও জুনিয়ার লাইব্রেরিয়ান অ্যাসিসটেন্ট মিলিয়ে রয়েছে ১৯৮ টি শূন্যপদ। অর্থাৎ এই মুহূর্তে মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনস্তরের লাইব্রেরি মিলিয়ে রয়েছে মোট ২৪০ জনের শূন্যপদ। অঙ্কটা কিন্তু সহজ নয়। এই অবস্থায় বন্ধ হবার জোগাড় জেলার ৫০ অধিক গ্রন্থাগার। একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে লালগোলার বালু টুঙ্গি ঝর্ণা সমিতির লাইব্রেরি, গণকরের রাজনগর প্রগতি সংঘের লাইব্রেরি, নবগ্রামের গোপগ্রামের গ্রামীন গ্রন্থাগার সহ জেলার একাধিক লাইব্রেরি। এই অবস্থায় একজন গ্রন্থাগারিককে একটা পুরো লাইব্রেরি সামলানোর পাশাপাশি, পার্শ্ববর্তী লাইব্রেরিও সামলাতে হয়। ফলে রোজ খোলা হয় না লাইব্রেরি। খাতা কলমে খোলা থাকলেও অচলাবস্থা জেলার সিংহভাগ গ্রন্থাগারেই।
জেলার লাইব্রেরিগুলিতে এই অচলাবস্থা কীভাবে তৈরি হল? কার ঔদাসিন্যে? মুর্শিদাবাদ, সেই জেলা যেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজ্যের প্রথম বইমেলা। এখন ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা’ ঘিরে সারা রাজ্যের পাঠক সমাজের দৃষ্টি থাকে। কিন্তু সেই কলকাতা বইমেলার ১৩ বছর আগে এই জেলার মাটিতেই জঙ্গিপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজ্যের প্রথম বইমেলা। তারপরে ১৯৮১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বহরমপুরে ব্যারাক স্কোয়ারের মাঠে হয়ে চলেছে বইমেলা। এই বছর ৪৩ তম বছরে পা দিল জেলা বইমেলা। এবারে বইমেলা চলবে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত ও বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮০ টি বুক স্টলও আসবে মেলায়। পাঠকেরা ভিড় করবে। বইমেলাও হবে ঘটা করে, কিন্তু কাটবে কী জেলার লাইব্রেরিগুলির অচলাবস্থা ?
আগে জেলায় লাইব্রেরি ছিল না, এখন লাইব্রেরি হয়েছে, বইও আছে, কিন্তু দেখভালের অভাব। একজন গ্রন্থাগারিকই হলেন একটি গ্রন্থাগারের ধারক-বাহক। তিনিই বাড়ির মতো আগলে রাখেন তাকে সাজানো হাজার হাজার বই। আর সেই স্থায়ী গ্রন্থাগারিকের অভাবে জেলার লাইব্রেরিগুলি। বন্ধ লাইব্রেরি থেকে ফিরে আসতে হচ্ছে পাঠকদের। প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে জেলার পাঠক সমাজ। এই বঞ্চনার ছবিটা পাল্টাবে কবে, প্রশ্ন থাকছে প্রশ্নেই।