পবিত্র ত্রিবেদীঃ শনিবার দুপুর। বহরমপুর রবীন্দ্রসদনের (Berhampore Rabindarsadan) পিছনের দিকে রাস্তা। সেখানেই দেখা মিলল বেলডাঙ্গার চঞ্চল ঘোষের (Chanchal Ghosh) । পুরনো সাইকেলের ক্যারিয়ারে ঝোলার মধ্যে থাক থাক করে রাখা বই । ভাঙ্গা সিটে ঠেস দিয়ে মলিন ঝোলায় উঁকি বহু মূল্যবান নতুন বইয়ের। প্লাস্টিকের চপ্পল। মাথার চুলে পাক ধরেছে কিছুটা। অভিজ্ঞতার ঘোলাটে চোখ সারাক্ষণ বইয়ের এ মলাট থেকে অন্য পাতা ঘুরে বেরাচ্ছে। মাঝে মাঝে চঞ্চল পরখ করে নিচ্ছেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রেতার চাহিদা ।
আসলে বইয়ের ভুবনে ভ্রাম্যমান বুকস্টোর এই ভদ্রলোক। সাইকেলে বই ফেরি করেন ষাটোর্ধ চঞ্চল ঘোষ । নেশার টানে অলিগলি ঘুরে বই বিক্রি করেন তিনি। বেলডাঙ্গা (Beldanga) থেকে ট্রেনে প্রতিদিন বহরমপুরে (Berhampore) আসেন। এখানে ভাড়া করা সাইকেলে ঘুরেঘুরে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেন বই। কোভিডকালে (Covid period) ১৯ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসেছন বহরমপুরে । সব দলের নেতা থেকে ছাত্র শিক্ষক তার বইয়ের ক্রেতা।
“ লোকে মুদির দোকানে চাল, নুন ধারে কেনেন। সেরকম মাসকাবারি অনেকে আমার কাছে বই কেনেন” , বলছেন চঞ্চল বাবু । বই বিক্রি আগের মতোই আছে। সাইকেল করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বই বিক্রি করা চঞ্চল ঘোষ জোর গলায় এই দাবি করছেন । ষাটের কোঠায় দাঁড়িয়েও তিনি আগের মতোই প্রতিদিন বই বিক্রি করতে শহরে ঘোরেন। মিটিং, মিছিল, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বই নিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তেও ছুটে চলেন। পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত কর্মী চঞ্চল ঘোষ । কিন্তু, এটা তার নেশা। শুরু হয়েছিল ২৬ বছর বয়সে। শাসকের জমানা বদলেছে। আজও তিনি বইয়ের সম্ভার নিয়ে আগের মতই আবেগপ্রবণ । অনলাইনের যুগে তিনি যেন বহন করেন ভ্রাম্যমান বুকস্টোর । ছাত্র থেকে শিক্ষক। সরকারি কর্মচারিদের কেউ কেউ তার কাছ থেকে নিয়মিত বই কেনেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
ভালবাসার টানে তার বই ভুবনের ঝাঁপি খুলতে গিয়ে নস্টালজিক। সেখানে তিনি বললেন, এক সময় মহাকরণ , রাজভবনেও বই দিয়ে এসেছি। মূলত বামপন্থী রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ের বই বিক্রি করি। বলেই পাতা ওলটাতে শুরু করেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর (Buddhadeb Bhattacharjee) লেখা ‘ নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’( Natsi Germany Jonmo Ebong Mrityu) , ‘আজকের চে’(Ajker Che) , ‘কেন কমিউনিস্ট পার্টি করা দরকার?’ (, এর মতো একাধিক বইয়ের । অকৃতদার এই মানুষটি বেলডাঙ্গা থেকে গাড়িতে এসে একটি সাইকেল ভাড়া নিয়ে শহর ঘোরেন। বাদ যায়নি করোনার সময়ও। চঞ্চলবাবু বলেন, “বহরমপুর ছাড়াও নদিয়া, কলকাতা ছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ কর্মসূচিতে গিয়ে সেখানে বিক্রি করি। বই পড়ার আগ্রহ বেড়েছে। বামফ্রন্টের ব্রিগেডে, প্রতিষ্ঠা দিবসে নিয়মিত কলকাতা যাই । সেখানে নিয়মিত স্টল দিই । সিপিএম দলে বই পড়ার নেশা”।
তিনি ৪০ বছর ভাতের বদলে দুবেলা রুটি খান। দুই দিদির কাছে থাকেন। আর নতুন বই কিনে বিক্রি করার স্বপ্ন দেখেন। ভালবাসার টানেই তার এই পথ বেছে নেওয়া। ঝুলিতে মজুত দুনিয়া কাঁপান দশ দিন (Ten Days That Shook the World) , ম্যাক্সিম গোর্কির ( Maxim Gorky) মা (Mother) কিংবা কার্ল মার্কস (Karl Marx), অমর্ত্য সেনের (Amartya Sen) বই। প্রতিদিন স্বল্প পূঁজির বইয়ের তাকে যুক্ত হয় মনোজগতের নতুন কোনও সৃষ্টি।