নিজস্ব সংবাদাতাঃ মধ্যবঙ্গের মুকুটে নতুন পালক। জিআই ট্যাগ পেল মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের শিল্পীদের হাতে তৈরি কোরিয়াল, গরদের শাড়ি। পূর্ব বর্ধমানের টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের শিল্পীদের হাতে তৈরি কোরিয়াল, গরদের শাড়ি পেল জিআই ট্যাগ পেল। খবর আসা পরেই স্পেস এক্স (Space X) হ্যান্ডেলে জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও নদীয়া-পূর্ব বর্ধমান জেলার টাঙ্গাল, বীরভূমের কোরিয়াল। এই সমস্ত জেলার শাড়িও পেয়েছে জিআই ট্যাগ। বাংলার মুখ উজ্জ্বল করা ঋণ শাড়ির কারিগরদের শুভেচ্ছা জানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “সমস্ত কারিগরদের আমি শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ওঁদের এই সাফল্যে আমরা খুব গর্ববোধ করি”।
পুজো থেকে পারিবারিক উৎসব, গরদ বাঙালির চির চেনা শাড়ি। শাড়ি প্রেমীরা মনে করেন, গরদ শাড়ি অবশ্যই হতে হবে খাঁটি রেশম সুতোয় বোনা। এই শাড়ি বোনা হয় মুর্শিদাবাদের মির্জাপুরে। কোরিয়ালের ও অন্যতম কেন্দ্র মুর্শিদাবাদের মির্জাপুর। তবে শাড়ি প্রেমীদের সাফ কথা, এই দুই শাড়ির জিআই ট্যাগ প্রাপ্তি আসলে মুর্শিদাবাদ সিল্কের স্বীকৃতি । মুর্শিদাবাদ জেলার নামের সাথে জড়িয়ে আছে মুর্শিদাবাদ সিল্ক। তবে এই সিল্ক আসলে মুর্শিদাবাদ জেলার থেকেও পুরোনো। অধ্যাপক সৌমেন্দ্রকুমার গুপ্ত লিখছেন, “ মুর্শিদাবাদ নামাঙ্কিত শহরটির পত্তনেরও প্রায় দু’হাজার বছর পূর্ব থেকেই এই অঞ্চলের রেশম ও রেশমি বস্ত্রের সুখ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল”।
মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলে যে এক ধরণের রেশমি বস্ত্রশিল্প বিদ্যমান ছিল তা নাকি প্রথম জানা যায় কৌটিল্যের ‘ অর্থশাস্ত্র’ বইটির কিছু টীকা থেকে। বোঝা যায় মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলে রেশম শিল্পের উদ্ভব ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ববর্তী সপ্তম শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ববর্তী তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী কোনও সময়ে। মোঘল আমলে মুর্শিদাবাদ সিল্কের নিজস্ব পরিচয় গড়ে ওঠে।
সিল্কের ব্যবসা ঘিরেই জেলায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল ওলন্দাজদের কুঠি। ব্যবসায়কে অন্যমাত্রা দেন ইংরেজ, ডাচ বণিকরা। রেশম পৌঁছায় ইউরোপেও। মুর্শিদাবাদ একদিকে ছিল সুবে বাংলার রাজধানী, অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র।
ইতিহাসের অসুসন্ধানীরা জানান , সুদূর অতীত থেকে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতেও মুর্শিদাবাদ রেশম শিল্প ও ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মুর্শিদাবাদ সিল্ক সেই সময় থেকেই জেলার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই জেলার মির্জাপুর সেই রেশম বস্ত্র শিল্পের অন্যতম ঘাঁটি। নানান চড়াই উতারাই পেড়িয়ে মুর্শিদাবাদ সিল্কের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন মির্জাপুরের শিল্পীরা।
এখনও হাতে টানা তাঁতের শব্দে বোনা হচ্ছে মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি। বোনা হচ্ছে মুর্শিদাবাদ সিল্কের গরদ, বালুচরী, স্বর্ণচরী। তানা আর বানার গল্পে বোনা হচ্ছে হাজার রঙের আশ্চর্য বুনন। ব্যবসায়ীরাও জানাচ্ছেন, নতুন করে হারানো বাজার ফিরে পাচ্ছে মুর্শিদাবাদ সিল্ক।
মির্জাপুরে ঢুঁ মারতে দেখা গেল, তানা আর বানার মাঝে বোনা হচ্ছে সিল্কের শাড়ি । মাঝে আঁচল জুড়ে খেলা রংবাহারি। কোনটায় বাঙালি বিয়ের ছবি। কোনটায় ফুটে উঠছে অভিজ্ঞান শকুন্তলম। ফুটে উঠছে মেধা, শ্রমের মিশেলে । একদিকে বাজারে কমদামী সিল্কের দাপট, অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানির গ্রাস। দুই থাবা থেকে বুক দিয়ে মুর্শিদাবাদ সিল্ক আগলে রাখছেন মির্জাপুরের তাঁত শিল্পীরা । শুধু বাঁচিয়ে রাখাই নয়, দিচ্চছেন নতুন জীবন। নতুন করে ফিরিয়ে আনছেন বালুচরিও। এক একটা শাড়ি বোনার প্রক্রিয়া আসলে বেশ কয়েক মাসের । বাংলা বছরের অঘ্রাণ মাসের আগেই রেশম গুটি কেনেন শিল্পীরা। চলে গুটি থেকে সুতো ছাড়ানোর পালা। বৈশাখ অবধি সুতো ছাড়ানোর মতো আবহাওয়া থাকে। এর পর সেই সুতোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়।
গরদ আর বালুচরী তৈরীর জন্য সুতোকে ‘টুইস্টিং’ করা হয়। সম্পূর্ণ হাতেই হয় কাজ। তাঁতে ‘টানা’র জন্য ব্যবহার করা হয় সুতোর দুই দড়ির এই টুইস্টিং। আর ‘বানা’ বা ‘ভরনা’র জন্য ব্যবহার করা হয় আর একটি সুতো তার আগে ব্লিচ করা হয় সুতোকে। প্রিন্ট করা মুর্শিদাবাদ সিক্লের জন্য যদিও আগে সুতো দিয়ে বোনা হয় থান। তারপর সেই থানকে ব্লিক করে দেওয়া হয় পছন্দের রঙ। তার উপর চলে দক্ষ শিল্পীদের হাতের নকশা। এক একটি শাড়ি তৈরী করতে সময় লাগে ৭ থেকে ৮ দিন। মুর্শিদাবাদ সিল্কে বোনা গরদ, কোরিয়াল শাড়ির দাম বেশ খানিকটা চড়া।