গ্রামেই ১০০ দিনের কাজ চাইছেন পরিযায়ী শ্রমিকরাও

Published By: Madhyabanga News | Published On:

বিদ্যুৎ মৈত্র, বহরমপুরঃ সাক্ষাৎ মৃত্যু মুখ থেকে ঘুরে এলেন ৪১ জন পরিযায়ী শ্রমিক। ধস নামার কারণে উত্তরাখন্ডের উত্তরকাশীর কাছে একটি নির্মিয়মান সুড়ঙ্গের ভিতর আটকে পড়েছিলেন তাঁরা। অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতরে, বাইরে উৎকন্ঠায় কেটেছে টানা সতের দিন। অবশেষে মঙ্গলবার রাতে মুক্তি। তার জেরে দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে শুধু ওই ৪১জন শ্রমিক ও তার পরিবারই স্বস্তি পায়নি। স্বস্তি পেয়েছে মুর্শিদাবাদেরও কয়েকলক্ষ শ্রমিক ও তার পরিবার, দাবি কর্ণাটকে রাজমিস্ত্রীর কাজে যাওয়া বহরমপুরের উপকন্ঠে আয়েশবাগের মধ্যবয়সী তাপস মন্ডলের।

অগ্রহায়ণের ধান কাটা শুরু হয়েছে। গোলায় উঠবে নবান্ন।  খেত মজুরের কাজও শেষ হয়ে যাবে আর ক’দিন পরে। তারপর! ফের ট্যুরিস্ট ব্যাগে সংসার পুরে যেতে হবে ভিনরাজ্যে। অচেনা ঠিকানায়। পিছনে পরে থাকবে সংসার, কোলের শিশু। সুতির মহেশাইল গ্রাম পঞ্চায়েতের সোলেমান সেখ বহরমপুর স্টেশনে বসে বলছিলেন। কতকটা যেন আনমনে। সোলেমন এবার ধান কাটার কাজও পাননি। হায়দ্রাবাদ থেকে দিন দশেক আগে গ্রামে ফিরেছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। ফিরে যাচ্ছেন ।

কথাগুলো আত্মকথনের মত শোনালেও সোলেমান সেখের চোখ  চকিতে চকচক করে ওঠে সুড়ঙ্গের শ্রমিকদের কথায়। “প্রথম দিকে খুব চিন্তা হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আর হয়ত ওদের কারও সঙ্গে দেখা হবে না পরিবারের। মাঝখানে সরকারের হস্তক্ষেপে মনে হচ্ছিল ফিরে আসবে। কিন্তু এত ব্যবস্থা করেও প্রায় সবকিছুই যখন ব্যর্থ হচ্ছিল তখন আবার মনে হচ্ছিল সব আশা জলে গেল। যাক শেষমেশ উদ্ধার হল।” স্বস্তার লম্বা একটা ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করে আবার সেই সুড়ঙ্গের কথায় ফিরে গেলেন তিনি।

হরিহরপাড়ার টনিক শেখ ব্যাঙ্গালুরুতে ডেলিভারী বয়ের কাজ করেন । মাস গেলে আঠারো বিশ হাজার টাকা আয় হয়। ফোনে ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “গ্রামে তো এখন মাটি কাটারও কাজ নেই। গ্রামে ফিরে হবেটাই বা কী?” পরক্ষণেই তোপ দেগে বলেন, “পত্রকার তো কেন্দ্র সরকারকে বলুন একশো দিনের টাকা রাজ্যকে দিতে, আমরা তো তাহলে গ্রামে থাকতে পারতাম।” ভিনরাজ্যে এবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের কখনও রোহিঙ্গা, কখনও বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় বলে ঝাঁঝালো স্বরে জানান টনিক।

কেরালায় একজন রাজমিস্ত্রীর দৈনিক আয় ন’শো টাকা। রবিবার অর্ধেক কাজ তাই ৪৫০টাকা। মাসে ২৬ থেকে ২৭ হাজার টাকা আয় হয়। ব্যাঙ্গালূরুতে আয় হয় দৈনিক ছ’শো টাকা হিসেবে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। একশো দিনের কাজে দেওয়া হয় দিন প্রতি ২৭০টাকা। তিরিশ দিন কাজ করলে আট হাজার টাকা আয় হয়। না হলেও পাঁচ-ছ’ হাজার টাকা হয়। একশো দিন যদি কাজ চলে ২৭ হাজার টাকা। গড়ে আট-ন’হাজার টাকাও আয় হয় মাসে। খাতা কলমে হিসেব করে দেখালেন সাগরদিঘির মইনুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “এবার আসুন চাষের কাজে। সবার তো জমি নেই। অধিকাংশই পরের জমিতে ক্ষেত মজুরের কাজ করে। কেউ আধাআধি চুক্তিতেও কাজ করে। এই কাজটা প্রতি তিন মাসে পাওয়া যায়। মাটি নিড়ানো থেকে ফসল তোলা অবধি।” মইনুলের হিসেবে মাটি কাটার সময় মজুরি তিনশো টাকা। আর ফসল কাটার সময় মজুরি পাঁচশো টাকা। তাতে একজন ক্ষেত মজুর দৈনিক কাজও পেতে পারে। তখন হিসেব করে দেখা যায় সেখান থেকে সাত আট হাজার টাকা গড়ে হিসেব হয় বলে দাবি তাঁর। এরপরেও কাজ থাকে জমি তৈরির জন্য।

নওদার সারোয়ার জামান বলেন, “গ্রামে থাকলে মাসে গড়ে হাজার বারো থেকে পনেরো রোজগার এখনও করা যায়। যদি একশো দিনের কাজের টাকা দেয়।” তেমনি চাষের থেকেও আয় কমেছে। চাষি ফসলের দাম পেলে তবেই বেশি মজুরী পাওয়া যায় পরের বার।আবার কাজের থেকে বেশি মজুর হয়ে গেলে আয় কমে যায়। সহজ অর্থনীতি বুঝিয়ে সারোয়ার বলেন, “অনিশ্চয়তা সব জায়গাতেই। কিন্তু গ্রামে থাকলে সংসারে থেকে ছেলেমেয়ের কাছে কাটানো যায়। সেখানে তো কাজই নেই।” ইন্টারস্টেট মাইগ্রান্ট ওয়াকার্স ফেডারেশন অব কর্ণাটকের  সম্পাদক আবদুর জব্বার বলছেন, “ভিন রাজ্যে আমাদের জীবনের কোনও সুরক্ষা নেই। আমাদের গ্রামের গোয়ালে গরুছাগলও আমাদের থেকে ভাল থাকে।আমাদের সে সুযোগও নেই।” তিনি আরও বলেন, “দেখলেন তো সরকার চাইল বলেই ওই ৪১জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হল। না চাইলে পচে মরত সুড়ঙ্গে। এখানেও তাই সরকার চাইলে আমরা গ্রামে বিড়ি বেঁধেও খেতে পারতাম। সরকার চাইছে না বলেই আমাদের মাটি কাটার কাজও জুটছে না।”