ঋত্বিক দেবনাথ ও দেবনীল সরকারঃ জ্বলছে রাজ্য তবে মাঠ কাঁপাচ্ছে মণিপুর। সুদূর মণিপুর থেকে এসেছেন খুদে ফুটবলাররা। প্রায় তেরোশো কিলোমিটার দূর থেকে এসেছেন বহরমপুরে। নিজেদের ঘর ছেড়েছেন দিন পনেরো আগে। কাঁধে নিয়ে কুড়ি জন চোদ্দ বছর বয়সী ফুটবলারের দায়িত্ব। বহরমপুর স্টেডিয়ামে চলছে অনূর্ধ্ব চোদ্দ জাতীয় স্তরের ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশিপ। সেখানে অংশ নিতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে ফুটবল টিম। সেখানে অংশ নিয়েছে মণিপুরও।
জ্বলছে জন্মভূমি মণিপুর, প্রতিদিন ভাঙছে হাজারও স্বপ্ন। উদ্ভ্রান্ত যুবসমাজ। তবে, এর মাঝেই নতুন স্বপ্নের খোঁজ। প্রতিকূলতা কাটিয়েই মাঠে নামা। মণিপুর থেকে বহরমপুর, গল্প কিন্তু সহজ ছিল না। ছিল অশান্ত গ্রাম থেকে শিশুদের ভিনরাজ্যে নিয়ে আসার ঝক্কি। কিন্তু স্বপ্নের সন্ধানে ফুটবল আর স্পাইক ব্যাগে বেঁধে পারি দূরদেশে। সাথে করে আত্মীয় পরিজনদের অগাধ আস্থা, জানালেন ফুটবল কোচ, মোইরাংথেম দেবেন সিংহ ও ম্যানেজার মুতুম তোম্বীমাচা সিংহ। বহরমপুরে এই দুজনই প্লেয়ারদের লোকাল গার্জেন।
বছর ৫৫-এর কোচ দেবেন সিংহ। ছোট থেকেই ফুটবলের সাথে আত্মিক সম্পর্ক তাঁর। ১৯৭৩ সালে খেলেছেন রাজ্য স্তরেও। তবে ফুটবল খেলার পাশাপাশি ফুটবল ট্রেনিং দিয়ে ফুটবলারদের তৈরি করাতেই স্বাচ্ছন্দ্য তাঁর। দিন পনেরোর প্রস্তুতিতেই মণিপুরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তুলে এনেছেন খেলোয়াড়দের। দিয়েছেন ট্রেনিং, জুগিয়েছেন তাঁদের বাবা মাকে আস্থাও। তবেই না এই অশান্ত সময়েও বাচ্চাকে পাঠিয়েছেন কোচের দায়িত্বে। এ যেন ফুটবলেরই কোচ নন, জীবনেরও বলছেন ফুটবলাররা।
মনিপুর ফুটবল টিমের ম্যানেজার, মুতুম তোম্বীমাচা সিংহ তিনি এক মজার মানুষ। মনিপুরের স্থানীয় একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। স্কুলে ছুটি নিয়ে এসেছেন ফুটবল টিমের সাথে। কারণ দুটি। এক, ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা আর দুই, খুদে ফুটবলারদের উন্মাদনা, তাঁদের নিয়ে উচ্চাশা। মুতুম ভাঙা হিন্দি ও ইংরাজি মিশিয়ে বলেন, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে, কাঠখড় পুড়িয়ে এই বাচ্চাদের নিয়ে এসেছি। যাতে ওদের একটা ভালো ভবিষ্যৎ দিতে পারি। ওরা প্রত্যেকেই ভালো খেলোয়াড়। ট্রেনিং-এর মধ্যে থাকে, কিন্তু ইদানিং আমাদের রাজ্যের যা পরিস্থিতি তাতে করে ওরা ভয় পাচ্ছে। ওদের ভয় কাটাতেই আরও ভিন রাজ্যের খেলার ময়দানে নিয়ে আসা।” ম্যানেজার আরও বলেন, ভারতের ফুটবল তো বাংলা থেকেই শুরু হয়েছে। সেই বাংলায় এসে ফুটবল চ্যাম্পিয়ানশিপ খেলতে উচ্ছ্বসিত তারাও।
তবে রয়েছে প্রতিকূলতাও। মানসিক তো বটেই, থেমে থাকেনি আর্থিক প্রতিকূলতাও। ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন থেকে যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল গাড়ি। তবে মণিপুর থেকে গাড়ীতে আসায় রয়েছে প্রাণের ঝুঁকি। অগত্যা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে বিমানের টিকিট কেটে দমদম, সেখান থেকে ট্রেনে বহরমপুর। যদিও বহরমপুরে এসে খুব খুশি ম্যানেজার, কোচ থেকে ফুটবলার সকলেই। মুর্শিদাবাদ ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসসিয়েশনের প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ।
খেলতে এসেছেন বাংলায়। খেলা হচ্ছে নবাবের দেশে। ফুটবল-স্পাইক ব্যাগে বিপন্ন মণিপুর থেকে বহরমপুরে রওশান, মালডিনোরা। লক্ষ্য একটাই, জয়। আগেই গোয়া ও পশ্চিমবঙ্গের টিমকে হারিয়ে সেমি ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে মণিপুর। এবার রবিবার সেমিফাইনাল। মাঠে নামবে মনিপুর ও অরুণাচলের অনুর্দ্ধ চোদ্দ টিম। একই সময়ে মালদা স্টেডিয়ামে খেলবে উত্তরপ্রদেশ ও মিজোরামের টিম। দুই সেমিফাইনালিস্টকে নিয়ে ১২ই সেপ্টেম্বর হবে ফাইনাল। কে পাবে জয়ের শিরোপা তার উত্তর মিলবে মঙ্গলবার।
তবে মণিপুরের টিমের কাছে এ নেহাতই খেলা নয়। এই জয়ের মাধ্যমে আরও শিশুদের মূলস্রোতে ফেরাতে চান টিমের কোচ। বলছেন, বন্ধ হোক দাঙ্গা, অশান্তি। ম্যানেজার, মুতুম তোম্বীমাচা সিংহ আবেগের সাথে বলেন, “জয়ের পরে বীর টিকেন্দরজিৎ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে কাপ দেখিয়ে সবাইকে বলব, এবার থামো। এই বাচ্চাগুলোর মুখ দেখে এবার তো থামো।”