দেবনীল সরকার, বহরমপুরঃ ‘গুড়’ নামটা শুনলেই মাথায় আসে শীতকাল। আর তা যদি হয় খেজুরের নলেন গুড়! তাহলে তো কথায় নেই। আর এই গুড়ের কারবার করেন রাধারঘাটের ঘেন্টু শেখ। বছর ৩৭ এর এই ব্যক্তি আজ প্রায় সাত বছর ধরে গুড়ের কারবার করছেন। শুধু গুড় বিক্রিই করেন না তিনি। নিজের হাতে খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি পেরে, সেই রস নিজে হাতে জ্বাল দিয়ে তৈরি করেন খাঁটি নলেন গুড়। আর সেই গুড়ের কারখানা থেকেই বিক্রি করেন গুড়। সব কাজই করেন একা হাতে। ঘেন্টু যেন খেজুর গুড় তৈরির ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’।
নেই কোনও দোকান। রাস্তার উপরেই ব্যবসা। যেখানে গুড় বানান সেখান থেকেই চলে বিক্রি। বিক্রিও হয় ভালোই, জানান ঘেন্টু শেখ। আর সবথেকে অবাক করা বিষয় হল, বাজারের থেকে প্রায় ১২০ থেকে ১৩০ টাকা বেশি দরে গুড় বিক্রি করেও, প্রতিদিন প্রায় কেজি সাতেক গুড় বিক্রি করেন আত্মবিশ্বাসী ঘেন্টু শেখ। তিনি জানান, বাজারে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে সারাবছর গুড় পাওয়া যায়। কিন্তু আমার গুড়ের ব্যবসায় কোন ভেজাল নেই। মানুষের চোখের সামনে গুড় বানাই। মানুষকে খাঁটি জিনিস খাওয়াই। চিনি মেশানো গুড় আমার কাছে হয়না।
বহরমপুরের কলেজ ঘাটের পাশ দিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ফেরিঘাটের ওপরে একটা ব্যানারে লেখা, “আপনার সামনে নিজ হাতে যত্ন সহকারে তৈরি করা হয়”। নৌকা করে ঘাট পার হয়ে যাবেন ওপারে। সকাল সকাল গেলে নৌকা থেকেই পাবেন গুড় জ্বাল দেবার গন্ধ। নৌকা থেকে নেমে আপনাকে গুড়ের সুগন্ধই নিয়ে যাবে ঘেন্টুর কাছে। সেখানে দেখবেন মাঠের ওপরে ফাঁকা জায়গায় ঘেন্টু শেখের চারকোনা বড় উনুন। সেখানে চার ফুট বাই পাঁচ ফুট অ্যালুমনিয়ামের পাত্রে রস জ্বাল দিচ্ছেন তিনি। আর পাশে দাঁড়িয়ে ক্রেতারা। অর্ডার করা থাকে আগে থেকেই। সেখানে গুড় তৈরি দেখে, সেই গুড় একটু চেখে, বাড়ির জন্য নিয়ে যান তাঁরা। ঘেন্টুর গুড়ের কারখানা আজ প্রায় সাত বছরের। বছরে তিনমাস গুড়ের ব্যবসা করেন আর বাকি নয় মাস কুলফি বানিয়ে বিক্রি করেন তিনি। গুড় বানানো শিখেছেন ছোটবেলায়। দেশের বাড়ি দেবগ্রামে। সেখানে দাদুকে দেখেছেন গুড় বানাতে, তারপরে বাবাও বানাতেন গুড়। এখন তিনিও একজন পেশাদার গুড় বানানোর ময়রা। ঘেন্টু জানান, ‘এভাবে গুড় হয়তো অনেকেই বানান কিন্তু সবার চোখের সামনে বানানোর ধক সবার নাই। ১০ লিটার রস থেকে এককেজি গুড় বানাই আমি। বাকিরা যেখানে ১০ লিটার থেকে আটকেজি গুড় বানাতে পারেন। আমার গুড়ে লাভ কম, মূল খরচ জ্বালানির। তাই নলেন গুড় ১৯০ টাকা প্রতি কেজি ও পাটালি গুড় ২২০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি করেন গুড়। বাজারের থেকে আমার তৈরি গুড়ের দাম বেশি। আর যারা গুড় নেয়, তাঁরা ভালো জিনিষের দাম দিতে পারে বলেই নেয়।’
ভোর তিনটেয় বিছানা ছেড়ে উঠে প্রথমেই চলে যান বাগানে। সেখানে গঙ্গার ধারে ৫৫ টি খেজুর গাছ আছে ঘেন্টুর। ভোর রাতে গাছে উঠে চলে হাড়ি পাড়ার কাজ। একটা গাছ থেকে কমবেশি এক থেকে দুই লিটার রস পাওয়া যায়। সেই রস নিয়ে ঘেন্টু আসেন তাঁর কারখানায়। সেখানে এসেই প্রথমে উনুন ধরিয়ে শুরু হয় জ্বাল দেবার কাজ। প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় ঘেন্টুর পছন্দের ‘নলেন গুড়’। আবার মাটি খোঁড়া আছে পাটালি গুড়ের মাপে। সেখানে কাপড় পেতে মাটির ছাঁচে ঢালেন গুড়। তৈরি হয় পাটালিও। ততক্ষণে এলাকা ভরে যায় গুড়ের সুগন্ধে। সাত বছরে ঘেন্টুর একমাত্র পাওয়া ক্রেতাদের ভালোবাসা। “যারা আমার কাছে একবার গুড় নিতে এসেছে তাঁরা নিজেরা তো বছরে তিনচার বার আসেই, আর সাথে করে আরও দু’তিনজনকেও নিয়ে আসেন। এভাবেই রোজ ছড়িয়ে পড়ছে গুড়ের ব্যবসা। লাভ কম হলেও, লোককে ভালো জিনিস দিই এটাই শান্তি।” বললেন ঘেন্টু শেখ।