Kandi Freedom Fighters: স্বাধীনতার ৭৫ বছরঃ কে মনে রেখেছে কান্দির সাবিত্রীচরণ বিনয়দের !

Published By: Madhyabanga News | Published On:

চন্দনা দত্তঃ মুর্শিদাবাদের কান্দি শহরের রূপপুর । আজও যেখানে মুখোপাধ্যায় বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের ওকালতির চেম্বারে দেওয়াল আলো করে শোভা পাচ্ছে পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী সাবিত্রী চরণ মুখোপাধ্যায়ের অর্জিত সেই তাম্রপত্র খানি । যেটি প্রদান করা হয়েছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর তরফ থেকে ১৯৭২ সালের ১৫ ই আগস্ট দিনটিতে । ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের ২৫ তম স্বাধীনতা দিবস পালনের দিনটিতেই ।

তাম্রপত্র টির একদম উপরে বাঁ দিকে রয়েছে অশোক স্তম্ভ ভারত সরকারের। তার নিচেই হিন্দি ভাষায় কয়েকটি লাইনঃ ” স্বতন্ত্রতা কে পঁচিচশবেঁ বর্ষ কে অবসর পর স্বতন্ত্রতা সংগ্রাম মে স্মরণীয় ইয়োগদান কে লিয়ে রাস্ট্র কি ওর সে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নে ইয়ে তাম্রপত্র ভেঁট কিয়া । 15 আগস্ট 1972 । 24 শ্রাবণ 1864 শকাব্দ”

রূপপুরে মুখোপাধ্যায় পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম আইনজীবী রজতশুভ্র মুখোপাধ্যায়৷, যিনি তাঁর পিতামহ স্বাধীনতা সংগ্রামী ঈশ্বর সাবিত্রী চরণ মুখোপাধ্যায়ের সেই সব সংগ্রামী দিনের বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরলেন । জানালেন অনেক কথাই ।

তখন ভারতবর্ষের মানুষ ব্রিটিশের শাসন শোষণে জর্জরিত নিপীড়িত । সেই সময় মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি শহরের বেশ কিছু এলাকা যেমন জেমো, রূপপুর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নানান কার্যকলাপের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এইসব জায়গাগুলোতে বিপ্লবীদের শরীর চর্চা থেকে সমস্ত রকমের গোপন আলাপ আলোচনা করা হত ।
কান্দি শহরের যেসব বিপ্লবী ছেলেরা এই কার্যকলাপে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম হল সাবিত্রী চরণ মুখোপাধ্যায় , দ্বিজপদ স্বর্ণকার , বিনয় চৌধুরী, মধুসূদন কবিরাজ , শিবু দাঁ , পতিতপাবন মিশ্র প্রমূখ। এঁদের মধ্যে বিনয় চৌধুরী যিনি কান্দির রূপপুরের বাসিন্দা জমিদার কেদারনাথ চৌধুরীর পুত্র ছিলেন। বড় হওয়ার সাথে সাথেই তিনি উপলব্ধি করেন যে করেই হোক দেশকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করতেই হবে । তাঁর এই ভাবনা পরিণতি পায় সাবিত্রী মুখোপাধ্যায়, মধুসূদন কবিরাজ প্রমুখদের সংস্পর্শে এসে । শুরু হয় কান্দির এই বিপ্লবী দলের সক্রিয় বৈপ্লবিক কাজকর্ম ।
সে সময় যাঁরা বিপ্লবী দলে নাম লিখিয়েছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে ইংরেজ পুলিশ অত্যাচার চালাত নানাভাবে । ইংরেজ পুলিশের কড়া নজরে তাঁদের গতিবিধি ছিল বলাই বাহুল্য । একদিন রাত্রে এইসব ছেলের দল কান্দি সাব জেলের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তাঁদের সংগঠনের কাজ সেরে । ঠিক তখনই বেশকিছু ইংরেজ পুলিশ তাঁদের ঘেরাও করে ফেলে । জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে। সদুত্তর আদায় করতে না পেরে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় বিপ্লবী দলের ছেলেদের সাথে ইংরেজ পুলিশের । ঘটনার পরে জরিমানা ধার্য করে পুলিশ ছেলেদের কাছ থেকে । কিন্তু কোন জরিমানাই দেয়নি বিপ্লবী দলের ছেলেরা সেই সময় । পরিণতিতে চলে আরো জুলুমবাজি ইংরেজ পুলিশের দলের ছেলেদের বাড়িতে এবার ।
এরপর ১৯৩২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি পুলিশ গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় বিনয় চৌধুরী সহ আরও কয়েক জনকে । বন্দী অবস্থায় কয়েকদিন কান্দির সাব জেলে রাখবার পর , পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বহরমপুর জেলে থাকতে হয় বিনয় চৌধুরীকে । সেখান থেকেও গোপনে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালাতে থাকেন বিনয় চৌধুরী । জেল কর্তৃপক্ষ তা জানতে পেরে যায় । এরপর বহরমপুর থেকে তাঁদের চালান করে দেওয়া হয় দমদম সেন্ট্রাল জেলে । সেখানে মার্চ মাস থেকে জুন মাস পর্যন্ত থাকতে হয় বিপ্লবী ছেলেদের । এরপর বিনয় চৌধুরীকে আরো নির্মম শাস্তিস্বরূপ চালান করা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নির্জন কারাবাসে । সেখানে বিনয় চৌধুরী জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ছিলেন বলে জানা যায়৷। এই তিন মাসে চরম নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো বিপ্লবীদের সাথে । জানা যায় শারীরিকভাবে বিপ্লবীদের দুর্বল করে দেবার ব্যবস্থাও করা হতো সেখানে। জেলে খাবারের সাথে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মিশিয়ে দেওয়া হত যাতে বিপ্লবী ছেলেরা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

রূপপুরে সে সময় তথাকথিত বিপ্লবী সাবিত্রী চরণ মুখোপাধ্যায়, যিনি বৈপ্লবিক কাজকর্মের প্রয়োজনে সুস্বাস্থ্য আর শারীরিক ফিটনেসে বিশ্বাসী ছিলেন । সে সময়ে কান্দির দোহালিয়া আর রুপপুরের ছেলেদের শারীরিক কসরৎ এর দিকে তিনি বিশেষ মন দিয়েছিলেন৷। সাবিত্রী চরণের নেতৃত্বেই রূপপুরে বিনয় চৌধুরীর বাড়িতে সেসময় চলত লাঠিখেলা থেকে কুস্তি আর ব্যায়াম এর অনুশীলন । সাথে চলত বিপ্লবীদের কাজকর্ম , সংগঠনের কাজ কর্ম । পুলিশের চক্ষুশূল হয়েছিলেন সে সময় সাবিত্রী চরণ মুখার্জি ও ।
এরপর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মুর্শিদাবাদে আসেন এবং কান্দির জেমো তে আসেন সভা করতে । সেই সভাতে কান্দির বিপ্লবী ছেলেদের নিয়ে যাওয়াতে এবং সভার কাজকর্ম সঠিক ভাবে করাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবিত্রী চরণ মুখার্জি । এই ঘটনার পরপরই সাবিত্রী চরণ অ্যারেস্ট হন ইংরেজ পুলিশের হাতে । কান্দির সাব জেল থেকে বহরমপুর হয়ে তাঁকে চালান করে দেওয়া হয় দমদম সেন্ট্রাল জেলে ।

এরপর অবশেষে অনেক রক্ত অনেক প্রাণ বলিদান এর পর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ , ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস । অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর ভারত রাষ্ট্র’ আজ বৃহত্তম সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ।

আজও কান্দির রূপপুরে মুখোপাধ্যায় পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান , সাবিত্রী চরণ মুখোপাধ্যায়ের পৌত্র আইনজীবী রজতশুভ্র মুখোপাধ্যায়ের চেম্বারের দেওয়ালে সাবিত্রী চরণ মুখোপাধ্যায়ের ছবি আর ঠিক তার নিচেই জ্বলজ্বল করছে স্বাধীন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর দপ্তর থেকে প্রদান করা তাম্রপত্র খানি । আমৃত্যু সাবিত্রী চরণ মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে ভারত সরকার প্রদত্ত পেনশন পেয়েছেন । তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী ঊষারাণী মুখোপাধ্যায়ও আমৃত্যু পেনশন ভোগী ছিলেন । পরাধীন ভারতবর্ষের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে একটা সময় লড়াই-সংগ্রামে কাটিয়েছেন বিনয় চৌধুরী , সাবিত্রী মুখোপাধ্যায় সহ কান্দির অন্যান্য সুসন্তানেরা । তবে কালের অমোঘ নিয়মে মানুষ অনেক খানিই বিস্মৃত হয়েছেন তাঁদের এই অবদানকে । রজতশুভ্র বলেন, ” মুর্শিদাবাদ জেলা বাসী হিসেবে আমরা কিন্তু কখনই চিরতরে বিস্মৃতির অতল গহবরে হারিয়ে যেতে দেব না সাবিত্রী চরণ , বিনয় , দ্বিজপদ , মধুসূদন , শিবু , বা পতিতপাবন দের” ।