“তিনি ভালো ভাবেই জানেন সমাজের দুর্নীতি রুপ মারন ব্যাধি নির্মুল করতে একবারে পারবেন না,কিন্তু বিচারপতির আসনে বসেও সীমিত ক্ষমতায় শুরুটা করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই”, লিখলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রাণময় ব্রহ্মচারী
প্রাণময় ব্রহ্মচারী, বহরমপুরঃ তিনি ভালোভাবেই জানেন, বিচারকের আসনে বসে অনেক কথা বলা যায়না ! কিন্তু তিনিই আবার এজলাসের বাইরে জনতার দরবারে ঠারেঠোরে সেই ইঙ্গিত দিলেন তিনিও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন “এখনও “, বিচারের বাণী…. নিভৃতে কাঁদে!”। আর কয়েক মাস পরেই ২০২৪ সালের মার্চ মাসে হাইকোর্ট এর মহামান্য বিচারপতির পদ থেকে তিনি অবসর নেবেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই রাষ্ট্র – সমাজ,সরকারের দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলতে বিচারপতির এজলাসে বসেই যেভাবে সক্রিয় হয়েছেন, বিচারকের আসনে না থেকেও পরবর্তী অবসর জীবনে সমাজের দুর্নীতির ক্যান্সারের উপশম করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলবেন তারই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত মিলল! যিনি এখন আম বাঙালির কাছে ” জ্যান্ত ভগবান ” বা নয়া অবতার হিসেবে জনমানসের মণিকোঠায় পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছেন তিনি আর কেউ নন কলকাতা হাইকোর্টের অন্যতম বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলী!
সেই কবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অফ কমনস এর ১৮৬৮ সালের ১৬ই মার্চ অধিবেশনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্লাডস্টোন বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন ” Justice delayed is Justice denied!” পরবর্তীকালে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও এই উক্তি নিয়ে সরব হয়েছেন তা আজও বিচারপতি অভিজিৎ গাঙুলীর শনিবার বহরমপুরের জনতার দরবারে খোলামেলা বক্তব্যে সমান প্রাসঙ্গিক ভাবেই উঠে এসেছে । বিচারকের ভাষায় “কাজের মধ্যদিয়ে বলার চেষ্টা করেছি ভারতের বিচার ব্যবস্থাকে আইভরি টাওয়ারে না বসে মানুষের কাছে নেমে আসতে হবে! “তবুও কেউ যদি মামলা ফাইল করেন তবে বিচার পেতে১০/ ১৫ বছর লাগবে! ” যদিও তার ভাষায় “আইন জগতকে এখনো তার মনে হয়েছে চুড়ান্ত highest form of democracy! কিন্তু পরক্ষণেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ” আদালত হচ্ছে পয়সাওয়ালা মানুষের পয়সা খরচ করার জায়গা ” উদ্ধৃতি তুলে নিজের হতাশা ব্যক্ত করতেও কসুর করেননি! এমনকি বলেই ফেলেন”এই ব্যবস্থা থেকে সুরাহা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম,তবুও দ্রুত বিচারের ব্যবস্থার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখনো কোর্ট দেখিয়ে দেব,বাড়িতে উকিল ঢুকিয়ে দেবো বলে গালাগাল, হুমকি দেওয়া হয়! শত দুর্নীতির প্রমাণ হওয়ার পরেও কোনো দুর্নীতি প্রমাণিত হয়না, তিনি শ্লেষাত্মক মন্তব্য করেন সাক্ষী নেই, তাই দুর্নীতি নেই! সাক্ষী রেখে ঘুষ নেয়না,খুন হয়না,তাই নাকি দুর্নীতি হয়না,আজও circumstantial evidence সমান গুরুত্ব পায়না!”
রবীন্দ্রনাথের উক্তিও ” কাদম্বরী মরে নাই,কাদম্বরীকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে সে মরে নাই!” তবে কি সামনে শুধুই অন্ধকার? না তিনি আশাবাদী John Galsworthy র বিখ্যাত উপন্যাস Justice এর Faldar মতোই তিনিও বিশ্বাস করেন বিচারব্যবস্থাকে সংস্কার করতে হবে! আইনজীবী দের সমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজনে মামলা বিচার কালীন সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে যদিও তা কিছু জনবিরুদ্ধ হতে বাধ্য!
এই কথা অনেকের গাত্রদাহ হয়েছে,তিনি আইনি এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে mad,nonsense এর মতো নন ইস্যুকে, ইস্যু বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি! তবুও তিনি কাজটা শুরু করেছিলেন সেই রাস্তায় আজ অনেকেই এগিয়ে এসেছেন, এমনকি জেলা আদালতগুলিতেও আইনজীবী, বিচারকগণ এগিয়ে এসেছেন এটাই তো একটা ভালো লক্ষণ! তবে তিনি য়ে অল্পসময়েই মানুষের আশা ভরসার নাম হয়ে উঠেছেন শহীদ ক্ষুদিরাম পাঠাগারের সম্পাদক নীলেন্দু শেখর সাহার ভাষায় ” তিনি ছাত্র-য়ুবদের প্রেরণা, অশান্ত সময়ে সকলের কাছে তিনি লাইট হাউস! “ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা: সুবীর গাঙ্গুলীও তার সম্বন্ধে বলেন” জনমানসে নিজস্বতার গরিমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অভিজিৎ গাঙুলী!” তা আরও একবার প্রমাণিত হলো তাকে ঘিরে আমজনতা উন্মাদনায় মেতেছে,অনেকেই তার পা জড়িয়ে ধরে প্রণাম করতে গিয়েছেন, যুবক যুবতীরা, তার সাথে সেলিব্রিটি হিসেবে সেলফি তুলেছেন, এমনকি এক ফাঁকে তার হাতে অনেকে লিখিত আবেদনপত্র ও তুলে দিয়ে হস্তক্ষেপ চেয়েছেন, তিনিও তাদের আইনের পথেই লড়াই চালিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন , টাকা পয়সার অভাবের কথা বললে লিগ্যাল এইড থেকে সাহায্যের উপায়ও বাতলে দিয়েছেন!
একজন বিচারকের সমাজের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রয়াস ও জনমানসে তার গ্রহণযোগ্যতা দেখে রাজনীতির কারবারীরা তার পপুলারিটি এনক্যাশ করতেও পিছপা হননি। বহরমপুর বিজেপি বিধায়ক সুব্রত মৈত্র ( কাঞ্চন) ,মুর্শিদাবাদ প্রাক্তন বিধায়ক ও ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা বিভাস চক্রবর্তী সভার উদ্যোক্তা শহীদ ক্ষুদিরাম পাঠাগারের ” ঘরের লোক হলেও তাদের মঞ্চে সচেতন ভাবেই দেখা যায়নি,কিন্তু তাদের মঞ্চের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে। আর বহরমপুর কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী তো এক পা বাড়িয়ে অভিজিৎ গাঙুলীকেই আগামী দিনের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান বলে মন্তব্য করে বসেন! এমনকি তাকে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে ভোট দেওয়ারও আশ্বাস দিয়ে রাখতে কসুর করেন নি!কিন্তু দুদে বিচারক সচেতন ভাবেই কোনো মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত থেকেছেন। তবে অবসরের পর কী ?
সংবাদ মাধ্যম তাকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন ” লেখালেখি তো অবশ্যই করব, আরও” আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি,অনেকেই মুর্শিদাবাদকে নানা কিছুর মডেল হিসেবে বলে থাকেন কিন্তু বহরমপুরের মতো ৪০ বছরের একটা সংগঠন, ক্যান্সারের মতো মারনব্যধি উপশমের জন্য এই প্যালিয়েটিভ ইউনিট চালু করলো, এটা একটা শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত!,কলকাতায় হলে ঢক্কা নিনাদ পড়ে যেতো,সম্পুর্ন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এ ধরনের কর্মদ্যোগ ও নেওয়া যায়! “
জনমানসকে তার চুম্বক বার্তা ” স্বার্থপর হয়োনা,, ধান্দাবাজ হয়োনা! আর কে না জানে এখন তো সংসদীয় রাজনীতিতে এই দুটোশব্দই সমার্থক! তাই সংসদীয় রাজনীতি তার ” না পসন্দ”! তিনি ভালো ভাবেই জানেন সমাজের দুর্নীতি রুপ মারন ব্যাধি নির্মুল করতে একবারে পারবেন না,কিন্তু বিচারপতির আসনে বসেও সীমিত ক্ষমতায় শুরুটা করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই,তবে অবসরের পরেও নিপীড়িত সমাজ – ক্যান্সার প্যালিয়েটিভ ইউনিট (রোগের উপশম) রাখার লড়াই চালিয়ে যাবেন তারই ইংগিত দিয়ে রাখলেন! আর তাই শুনে আশায় বুক বাধছেন আম বাঙালি!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)