দেবনীল সরকার, বেলডাঙ্গাঃ লাইব্রেরি বা পাঠাগার কথাটির সাথে আমরা প্রায় সকলেই পরিচিত। কিন্তু আশেপাশে, পাড়ার মোড়ে যে লাইব্রেরি বা পাঠাগারগুলি একসময় মফস্বলের ‘কালচারাল ঠেক’ হিসাবে পরিচিত ছিল, কোথায় সেই পাঠাগারগুলি? নেই! দু’এক জায়গায় অস্তিত্ব থাকলেও সেগুলির অবস্থা জরাজীর্ণ। তবে কি হলো? গত বিশ বছরে কেন সমাজ গড়ার কারিগর বই, পাড়ার পাঠাগারগুলি থেকে মুখ ঘোরাচ্ছেন সাধারণ মানুষ? প্রশ্ন জটিল।
বই বিমুখতার প্রসঙ্গে অনেকেই কারণ দর্শেছেন মোবাইল আসক্তি। যা হয়তো একেবারেই উড়িয়ে দেবার কথা নয়। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বেলডাঙ্গার বাসিন্দ সফিকুর রহমান বলছেন , আমরা বাড়ির বাচ্চাদের বই দিইনি, হাতে তুলে দিয়েছি মোবাইল। মোবাইল দরকার। কিন্তু তার থেকেও বেশি দরকার, কাগজের পৃষ্ঠার বই। বেলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত নওদা গ্রামের এই পরিবেশ কর্মী অর্ধেন্দু বিশ্বাস নিজের বাড়ি থেকেই শুরু করেছেন বই নিয়ে এই সংগঠিত আন্দোলন। তাঁর দাবী, দোষারোপের দিন শেষ। পড়ুয়া সমাজ তৈরি করতে হলে বসে থাকলে হবে না।
বই নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চেতনা তৈরির চেষ্টায় নিজের বাড়ির একটি ১০ ফুট বাই ১৪ ফুট ঘরেই খুলে ফেলেছেন আস্ত লাইব্রেরি। আজ প্রায় এক হাজারেরও বেশি বই রয়েছে সেখানে। নাম দিয়েছেন ‘বিবেক পাঠাগার’। এই লাইব্রেরির কিছু নিয়মাবলী ঠিক করেছেন সদস্যরাই। যেমন এই লাইব্রেরির ৮০ শতাংশ বই থাকবে পুরনো। যেহেতু এই সংস্থার সাথে যুক্ত সকলেই একাধারে পরিবেশকর্মীও তাই একই সাথে গাছ লাগানোর বার্তাও দেবার জন্য পাঠাগারের তরফে ঠিক হয়, যত কপি নতুন বই কেনা হবে তত সংখ্যক গাছ লাগানো হবে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন প্রান্তে। আক্ষরিক অর্থেই এটি একটি গ্রিন লাইব্রেরি। এই অভিনব প্রচেষ্টায় । কাগজ ও বই একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িত সম্পর্ক থেকেই এই ‘বিবেক পাঠাগার’ -এর ভাবনা জানান সংস্থার তরফে অর্ধেন্দু বিশ্বাস।
গ্রিন লাইব্রেরিতে রয়েছে বই ব্যাঙ্ক। বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের অনুগামী স্বর্গীয় শ্রী অজিত কুমার বিশ্বাসের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ছিলেন তাঁর পরিবার বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে বই উপহার দিয়ে থাকেন প্রত্যেক বছর। এই বিষয়টির কথা মাথায় রেখেই স্বর্গীয় শ্রী অজিত কুমার বিশ্বাসের কন্যা কাবেরী বিশ্বাস ও ছন্দা বিশ্বাস সহ পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের উদ্যোগে বিবেক লাইব্রেরি-তে স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী অজিত কুমার বিশ্বাস স্মৃতি বই ব্যাংকের ও সূচনা হয়েছে বিবেক পাঠাগারে। প্রায় এক বছরের প্রচেষ্টায় তিলে তিলে গড়ে উঠছে এই পাঠাগার। যদিও এই গ্রিন লাইব্রেরির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ৭ ই মে। পরিবেশ কর্মী অর্ধেন্দু বিশ্বাস, তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু দক্ষিণ কোরিয়ায় গবেষণারত গবেষক অমিত কুমার মন্ডলের ও সংস্থার লোকজনের সহযোগিতায় ছড়িয়ে পড়ছে বিবেক পাঠাগার। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, ভ্রমণ কাহিনী, কল্প কাহিনী, কল্প বিজ্ঞান, কম্পিটিটিভ পরীক্ষার বই, বিনোদন, খেলাধুলা, চাষবাস, বাগান পরিচর্যা বিষয়ক ও ধর্মীয় প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ের উপলব্ধ এই পাঠাগারে।
পরিবেশ বান্ধব লাইব্রেরীতে যত সংখ্যক নতুন বই কেনা হচ্ছে তার সমসংখ্যক বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে। এছাড়াও যারা স্বেচ্ছায় বই দান করতে আগ্রহী সেই সমস্ত সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত আলমারিতে জমে থাকা বই নিয়ে ও লাইব্রেরীর সমস্ত গ্রন্থ নিয়ে অ্যাপ ও ডিজিটাল লাইব্রেরীও তৈরি হচ্ছে। বিবেক পাঠাগারের তরফে জানানো হয়, তাঁদের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল স্ট্রিট লাইব্রেরি। যা পূরণের দিকে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। স্টেশন, পাড়ার মোড়, রাস্তার পাশে বিভিন্ন জায়গায় দেওয়ালে দেওয়ালে থাকবে বুক সেল্ফ, তৈরি হবে স্ট্রিট লাইব্রেরি।