ঋত্বিক দেবনাথ, বহরমপুরঃ মুর্শিদাবাদ জেলা বাংলার অন্যতম প্রাচীন জেলা। ঐতিহাসিক এই জেলায় বর্তমানে একশ্রেণীর মানুষ সম্পূর্ণ চাষবাসের সাথে জড়িত। এবং অন্যদিকে রয়েছেন এক বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকেরা। ঠিক কী কী কারণে এই পরিসংখ্যান বেশি সেই উত্তর খুঁজলে বোঝা যাবে এখানকার শিক্ষার হার এবং অন্যদিকে কমবয়সী বিবাহের প্রবনতা। মঙ্গলবার রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠিত মুর্শিদাবাদ কমিউনিটি কনক্লেভে এই নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে জেলার বর্তমান অবস্থা, লোক শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি ‘মা ও শিশুর পুষ্টি’ বিষয়েও আলোচনা হয়। আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, জেলার ডেপুটি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডাঃ অশোক বিশ্বাস, পুষ্টিবিদ শ্রেয়া রায়চৌধুরী ও পূর্বাশা প্রামানিক এবং রাজনীতিবিদ তথা সমাজকর্মী শাওনি সিংহ রায়।
মুর্শিদাবাদ জেলার স্বাস্থ্য দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, পনেরো থেকে ষোলো বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবনতা বেশি। যার ফলে এই মেয়েগুলি কুড়ি, একুশ বছর বয়সেই গর্ভবতী হন। এই জেলায় প্রতিবছর প্রায় এক লক্ষ ষাট হাজার মহিলা গর্ভবতী হন এমনটাই পরিসংখ্যা দিচ্ছেন জেলার ডেপুটি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ডা. অশোক বিশ্বাস। এই সংখ্যার মধ্যে কুড়ি শতাংশই কমবয়সী। যার ফলে যে সমস্ত বাচ্চা জন্মাচ্ছে তাদের মধ্যে বাইশ শতাংশ বাচ্চাই আন্ডার ওয়েট বা অপুষ্টির শিকার। একটি পরিপুষ্ট বাচ্চার ওজন থাকা উচিত দুই থেকে আড়াই কেজি। সেখানে সদ্য জন্মানো শিশু এই ওজনের কম হলে সেই সমস্ত নবজাত শিশুদের খুব সাবধানে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
একে কমবয়সী মা তার ওপর কম ওজনের বাচ্চা প্রসব করলে সেই মা ও বাচ্চা উভয়েরই মৃত্যুর সম্ভবনা থাকে। এবং এই কারণেই প্রতি এক লাখে একশো পঞ্চাশ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এর মূল কারণ হিসেবে ডাঃ বিশ্বাস জানান, “মুলত পুষ্টির অভাবের কারণেই এমন সমস্যার তৈরি হয়েছে। পুষ্টির একটি নির্দিষ্ট চক্র রয়েছে। এবং যে সমস্ত মহিলারা রয়েছেন তাদের মধ্যে বাহাত্তর শতাংশ মহিলারই হিমোগ্লোবিন থাকে এগারোর নিচে। তাই এই অবস্থায় যে সমস্ত বাচ্চারা জন্মাচ্ছে তাঁরা ছোটবেলা থেকেই পুষ্টির অভাবে ভুগছে।”
এখানেই উঠে আসে ম্যালনিউট্রিশিয়ান। যার ফলে প্রচুর বাচ্চা মারা যাচ্ছে বা মায়েরা কষ্টের সাথে নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বাচ্চাকে বড় করছে। যেহেতু সদ্য জন্মানো বাচ্চার বয়স অনুযায়ী ওজন, উচ্চতার হারের নিরিখে মুর্শিদাবাদের অবস্থান খুব একটা ভালো না। যে সমস্ত মহিলা গর্ভবতী হন, সেই প্রক্রিয়াকালে অন্তত চারবার নূন্যতম স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে মুর্শিদাবাদ স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফ থেকে। সেখানে জেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে আলোচনা করা হয় পুষ্টি বিষয়ে।
জেলার মানুষের মধ্যে প্রসব সংক্রান্ত সাধারণ শিক্ষার ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে কখন বাচ্চা নিতে হবে, একটা বাচ্চা নেওয়ার পর আবার কত সময় পর আরেকটা বাচ্চা নেওয়া যায় এই সমস্ত বিষয়গুলি এখনও অনেক সংখ্যক মানুষের কাছে ধোঁয়াশায় রয়েছে। এবং যেহেতু জেলার মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ কম এবং এখানে অনেক সংখ্যক মানুষ এখনও গ্রামে বাস করেন তার ফলে তাঁদের পক্ষে দামি দামি চাইল্ড কেয়ার বা খাদ্যসামগ্রী কেনা সম্ভব নয়। যার ফলেও পুষ্টির অভাব প্রচণ্ড পরিমানে দেখা যায় গ্রাম বাংলার বাচ্চা ও মায়েদের।
সেই সমস্যার সমাধানে পুষ্টিবিদ শ্রেয়া রায়চৌধুরী জানান, “অঙ্গনবাড়ির তরফ থেকে এই কমিউনিটিতে যুক্ত সমস্ত মহিলাদের প্রতিদিন খিচুরি ও ডিম দেওয়া হয়। কিন্তু এমনও কিছু সংখ্যক মায়েরা আছেন যারা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই হয়ত সব সময় মাছ কিনে খেতেও পারেন না। কিন্তু তার পরিবর্তে নূন্যতম দামে বাজারে সহজেই উপলব্ধ হাইপ্রোটিনযুক্ত খাবার সোয়াবিন। প্রচুর পরিমানে প্রোটিন রয়েছে এবং কম দামেও পাওয়া যায় এবং আমিষ বা নিরামিষের কোন সমস্যাও থাকছে না। এছাড়াও যেহেতু মুর্শিদাবাদ জেলা নদী পুকুরের জেলা সেই কারণে এখানে প্রচুর পরিমাণে সহজেই গেঁরি গুগলি পাওয়া যায়। যাতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে।”
এছাড়াও শাক সবজির কথা উঠলে যেটি অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সবচেয়ে উপকারি সেটি হচ্ছে সজনের শাক এবং ডাঁটা। ১০০ গ্রাম সজনের শাকে প্রায় ২২.৫ গ্রাম প্রোটিন থাকে যা একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলার জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের জেলায় এই সহজলভ্য সবজিটিকে অবহেলা করা হয়। কিন্তু বিদেশে সজনে শাককে শুকিয়ে গুড়ো করে (মরিঙ্গা পাওডার) বিক্রি করা হয়। যেটি ২০০০ টাকা প্রতি কেজি দাম বিক্রি হয়।
আবার ম্যালনিউট্রিশিয়ান কেবল মাত্র যে পুষ্টির অভাবে হয় তাই শুধু না। আরেকদিকে অতিপুষ্টির ব্যাপার টাও ম্যালনিউট্রিশিয়ানের একটা অংশ। যেটি মেডিক্যালের ভাষায় বলা হয় ওবেসিটি। এটা বর্তমানে গর্ভবতী মা থেকে শুরু করে নবজাত শিশু সবার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। এবং এটিও একটি ক্ষতিকারক দিক। কীভাবে এটিকে প্রতিরোধ করা যায় সেই বিষয়ে পুষ্টিবিদ, পূর্বাশা প্রামানিক জানান, “যে মহিলারা কনসিভ করছেন, তাঁদের একটি সঠিক পুষ্টির চার্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। এবং দ্বিতীয়ত সদ্যজাত বাচ্চাদের ব্রেস্ট ফিড ঠিক মতন করানো হচ্ছে না, যেখানে বাচ্চা হওয়ার পরপরই এটি শুরু করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং সাথে সাথেই যদি ব্রেস্ট ফিড না করানো হয় তাহলে খুবই সমস্যা হয়। এছাড়াও ৬ মাস পর্যন্ত বাচ্চাকে খালি ব্রেস্ট মিল্ক খাওয়ানো উচিত। তার ফলে শিশু শারীরিকভাবে আরও বেশি শক্তিশালী হবে।”
এই সংক্রান্ত বিষয়ে রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী, শাওনি সিংহ রায় জানান, “মুর্শিদাবাদের নাম মাথায় আসলেই প্রথমে যেটা উঠে আসে সেটি হচ্ছে এটি একটি পিছিয়ে পরা জেলা। যেখানে বাল্য বিবাহের সংখ্যা বেশি। কিন্তু বর্তমানে যদি দেখা যায় এখন সরকারি উদ্যোগে মেয়েদের অনেক সুবিধে করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষারহার আরও বেড়েছে এবং তার প্রতিফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে মেয়েরা বেশি পরিমাণে কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে। এবং বাল্য বিবাহের সংখ্যা অনেকখানি নেমেছে। অপুষ্টির বিষয়ে আগে লালশিশুর (অপুষ্টি কর বাচ্চা) সংখ্যা ছিল ১৫০০-২০০০ এবং বর্তমানে সেটি দাঁড়িয়েছে ৩৫০ জন।”
বর্তমানে যে সমস্ত আইসিডিএস (Integrated Child Development Services) সেন্টারগুলি রয়েছে। সেখানে যে সমস্ত মহিলারা মা হওয়ার পর আসেন, তাঁদের পুষ্টির খেয়াল সবসময় রাখা হয়। মাসে ২৫ দিন তাঁদেরকে একটি নির্দিষ্ট মিল দেওয়া হয় মা এবং বাচ্চা উভয়কেই। এবং ১৫ দিন অন্তর অন্তর একটি প্যাকেজ দেওয়া হয় যেখানে নানা রকমের পুষ্টি পূরণ করার জন্যে ওষুধ থেকে শুরু করে অন্যান্য জিনিষ দেওয়া হয়ে থাকে। সরকারি উদ্যোগের থেকেও বেশি দরকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা। কী কী করলে আরও ভালো থাকবেন। কোন খাবার অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালিন খাওয়া প্রয়োজন সেই সমস্ত দিক মানুষের আগে শিখতে হবে বুঝতে হবে তবেই জেলা থেকে রাজ্যে এবং গোটা দেশে মা ও বাচ্চারা যারা আজ অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন তাঁদের পরিসংখ্যান কমবে।