ঋত্বিক দেবনাথ, বহরমপুরঃ কোনও বাজারে ঢুকলেই দেখা যাবে মুরগির পালক উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। কোথাও নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাস্তায়, চলছে কুকুরের কাড়াকাড়ি। কোথাও আবার মাছের আঁশ ডাঁই করে রাখা। কোথাও আবার ড্রেনের পাশে কাটা মাছ বিক্রি হচ্ছে বস্তার ওপর ফেলে। দু’পা এগোলেই মাছ-মাংস স্টলের ঠিক ডানদিকে নোংরা ফেলার ডাস্টবিন, ভেসে আসছে পচা দুর্গন্ধ। কোথাও আবার রাস্তার ওপর পরে রয়েছে শাক-সবজি তার ওপর দিয়েই হাঁটছেন লোকজন চলছে গাড়িঘোড়া। মাছবাজারের রক্ত, পচা শাক-সবজি মিলেমিশে বাজার যেন নরককুণ্ড! ভুক্তভোগী বহরমপুরের শহরবাসী।
বহরমপুর শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০টি শাক-সবজি, মাছ-মাংসের বাজারের হাল কমবেশি এমনই বেহাল। অথচ বহরমপুর শহরের রাস্তা ক্রমশ খোলতাই হচ্ছে। ভাল রাস্তার ওপর হালকা পিচ ঢেলে দিয়ে সেটিকে ঝাঁচকচকে বানানো হচ্ছে। সেখানেই খরচা হচ্ছে কোটি কোটি টাকার। এবং সেই রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছেন নেতা-মন্ত্রী-আমলা ও ঠিকাদাররা। তা হলে শহরবাসীর নিত্য যাতায়াত যেখানে, সেই শাক-সবজি, মাছ-মাংসের বাজারের চেহারা কেন আরও হতশ্রী হবে, সেটাই বাসিন্দারা অনেকে বুঝতে পারছেন না। কারন, সবচেয়ে পুরনো বাজার নতুন বাজার থেকে ফৌজদারি কোর্ট বাজার থেকে স্বর্ণময়ী বাজার, সর্বত্র প্রায় একই বেহাল দশা।
শহরের অন্যতম পুরনো বাজার ‘নতুন বাজার’ এলাকার কথাই ধরা যাক। বহরমপুর শহরের বাসিন্দা তথা বহরমপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নাড়ু গোপাল মুখার্জি এই বাজারের অবস্থা খুবই ভালো করেই জানেন। ওই বাজার কতটা অস্বাভাবিক নোংরা অবস্থায় রয়েছে সেই ব্যাপারে হয়ত অবগত নন তিনি। বাজারের মাছ-মাংস বিক্রেতাদের একটা চরম অপরিছন্ন পরিবেশে বসে ব্যবসা করতে হয় সেটাও সকলে জানেন। সেখানে যে ক্রেতারা নিয়মিত যাতায়াত করেন তাঁরাও কার্যত নিরপায় হয়েই যান।
বাজারের মধ্যে স্তূপ করে রাখা কাটা মুরগি মাংসের। তার পাশেই চলছে নতুন মুরগি কাটাও। একটু এগিয়ে গেলে চোখে পরবে মাছের বাজার। এবং নোংরা জল পাস করার জন্যে যে ড্রেন রয়েছে সেইগুলিও নোংরা জমে জমে ভর্তি। কিন্তু কেন এই হাল। রোজ নিয়ম করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বহরমপুর পৌরসভার তরফ থেকে পাঁচ টাকা করে ট্যাক্স হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয় । কী কারনেই বা নিয়ে যান। নতুন বাজারের মাছ ব্যবসায়ী গোপাল দাস জানান, ‘আজ দীর্ঘদিন ধরে আমি এই বাজারে মাছ বিক্রি করছি। এবং এই বাজারের হাল এই রকমই দেখে আসছি। মাঝে মাঝে সাফাইকর্মী আসেন সাফ করতে। কিন্তু বেশিরভাগ দিনই এইভাবে পরে থাকে বাজার। এরই মধ্যে ক্রেতারা আসেন কিনতে। আমাদের খারাপ লাগে এইভাবে ব্যবসা করতে। ডেঙ্গু হওয়ার ভয় থাকে। তাও করবটা কী ব্যবসা না করলে সংসার চলবে না’। একপ্রকার নাকে রুমাল চাপা এবং মাটিতে কাপড়টা একটু তুলে বাজার ঘুরতে হয় এখানে ক্রেতাদের।
পাশপাশি শহরের অন্যতম পুরনো বাজার ফৌজদারি কোর্ট বাজার। যদিও এটি একটি সান্ধ্যকালীন বাজার এবং বলা চলে চাকরিজীবী মানুষেরাই বেশিরভাগ আসেন এখানে বাজার করতে। সেখানেও উঠে আসছে সেই একই চিত্র। বাজারের গায়ে লাগোয়া একটি বড় হাইড্রেন যেখানে বেশ অনেক সময় ধরে জমে রয়েছে নোংরা জল। এইরকম ডেঙ্গি পরিস্থিতিতে কীভাবে এখনও এই সমস্ত ড্রেন পরিস্কার হয়নি তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। খোদ এখানকার ব্যবসায়ীরাই আতঙ্কে ব্যবসা করতে নামেন রোজ বলে জানান। নিত্যদিন এই বাজারেই বাজার করতে আসা ৬০ বছর বয়সী ক্রেতা রামচন্দ্র বিশ্বাস জানান, ‘খুবই সমস্যা হয় এখানে বাজার করতে। পাশেই এত বড় ড্রেন মশার উৎপাতও বেশ অনেকটা। ভয় হয় ডেঙ্গু হওয়ার। কিন্তু বাড়ির কাছে এটাই আর এখানে মালটাও ভালো। কিন্তু এখানে এখনও দেখলাম না কেও এই ড্রেন পরিস্কার করছে’।
কিছুটা দূর এগিয়ে গেলেই পরবে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এবং তার ঢিল ছোড়া দূরত্বতেই রয়েছে স্বর্ণময়ী বাজার। শহরের অন্যতম ব্যস্ত বাজার, যেখানে শহরের ক্রেতা ছাড়াও ভিড় করেন বাইরে থেকে ডাক্তার দেখাতে আসা রোগীরাও। ফলে সকাল থেকে চাপ থাকে অনেখানি। কিন্তু সেখানেও উঠে আসছে অপরিস্কারের একই ছবি। পরে রয়েছে মাছের আঁশ তো কোথাও মাংসের দোকানের পাশেই বড়সড় নোংরা ফেলার ডাস্টবিন। বাজার থেকে সবজি বা মাছ কেনার সাথে সাথে বিনামুল্যে ক্রেতারা উপভোগ করছে দুর্গন্ধেরও।
বহরমপুরের বেশ কিছু সংখ্যক চিকিৎসক নিয়মিত ওই বাজারে যাতায়াত করেন। তাঁদের একাংশের মতে, ক্রেতারা তো বাজারে সামান্য সময় থাকেন। কিন্তু, বিক্রেতারা ওই অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলে তাঁদের নানান ধরনের রোগের আশঙ্কা থেকে যায়। যে পরিকাঠামো রয়েছে সেটিকে আলোকিত করে, দুর্গন্ধের উৎস বন্ধ করলেই বাজারের চেহারা অন্যরকম হতে পারে বলে তাঁরা জানান। সে জন্যে বাজারের দোতলাও ব্যবহার করা দরকার। বিশেষত, মাংস বিক্রেতারা যে ভাবে খোলামেলা ভাবে ব্যবসা করছেন তা চরম অবৈজ্ঞানিক ও ভয়ঙ্কর দূষণ ছড়ায় বলেও পরিবেশবিদরা অভিযোগ করেন।
এছাড়াও যদি লক্ষ্য করা যায় মধুপুর বাজার এবং কান্দি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাজার তাহলে দেখা যাবে সেখানে অর্ধেকের ওপর বিক্রেতা বসেন খোলা ছাদের নিচেই। ফলে রোদ-বর্ষার মরশুমে প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখে পরতে হয়। এবং মধুপুর বাজার একদম জনবহুল এলাকাতে রাস্তার ওপর। খুববেশি হলেও ১৫ফুটের রাস্তা হবে। তারওপর দু’ধারে লম্বা রাস্তা জুড়ে বসেন সবজি বিক্রেতারা। ফলে সেই রাস্তা হয়ে যায় প্রচণ্ড ছোট। এবং নিত্যদিন লক্ষ্য করা যায় যানজটের। কবে মিটবে এই যানজট বলা মুশকিল।