একটি গ্রাম যেখানে জাতীয় উৎসব লক্ষ্মীপুজো
সুদীপ্ত দুবে
একদমই তাই-দুর্গাপুজোয় পোশাক-আশাক তেমন কিছু কেনা হয় না। এখানে দুর্গাপুজো নয়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই আসেন লক্ষ্মী পুজোয় (Lakhmi Puja)। লক্ষ্মীপুজোর ঘট ভরলে নতুন করে জেগে ওঠে গ্রাম। কেননা ওঁদের কাছে জাতীয় উৎসব লক্ষ্মীপুজোই। এটা মুর্শিদাবাদ জেলার একটি গ্রাম মনোহরপুরের গল্প। গ্রামে থাকা সব ধর্মের মানুষ লক্ষ্মীপুজোর উৎসবে অংশ নেন। বহরমপুর-কান্দি (Kandi) রাজ্য সড়কে অবস্থিত এই গ্রাম। বহরমপুর থেকে বর্ধমান হয়ে কলকাতা যাওয়া হয় এই রাস্তা দিয়ে। সাকিন অনুযায়ী, ওটা আন্দুলিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি গ্রাম মাত্র। কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর উৎসব অন্য কথা বলে। গ্রামের পুজো, প্রাণের পুজো।
Kandi Lakhmi Puja কথা বলছিলাম চর্মসার এক অশীতিপর বৃদ্ধের সঙ্গে। পুজোর ইতিহাস নিয়ে বয়স মোটামুটি ৮০ পেরিয়ে ৯০ এর কোঠায়। আতস কাচের মতো অত্যন্ত ভারী চশমাটা সরিয়ে রেখে মনে করার চেষ্টা করলেন, এই পুজোর শুরুর দিনের কথা। বলতে পারলেন না। বৃদ্ধ বললেন, ঠাকুরদার আমল থেকে দেখে আসছি এই পুজো। এবারের পুজোর সম্পাদক অজয় ঘোষ। গত কয়েক মাস হল তাঁর দু’বছরের নাতনিকে হারিয়েছেন। তবু তারই মধ্যে তিনি এই পুজোর মূল উদ্যোক্তা। জানা গেল মোটামুটি ১৮ শো সালের কিছু পর থেকেই এই পুজোর শুরু। শুরু হয়েছিল ‘অন্ত্যজ’ দাস পরিবারকে নিয়ে। তাঁরাই এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা। এরপরে ব্রিটিশ আমলে এই হিন্দু পরিবারদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার সীমাহীন হয়। তখন তাঁরা বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হন। এখনও তাঁদের বংশধররা রয়েছেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে মনোহরপুরে লক্ষীমাতার আয়োজনে তাঁদের আর দেখা যায় না।
আরও পড়ুনঃ Berhampore Labour বেঙ্গালুরুর ওই শ্রমিকদের জন্য ১০ লক্ষ দাবি সিটুর
Kandi Lakhmi Puja এখন মনোহরপুরের এই তিন দিনের পুজোয় সন্ধ্যা অমৃত হয় কয়েক হাজার মানুষের সঙ্গমে। বাউল, বোলান, কবিগান অথবা পুতুল নাচের মাধ্যমে। পাড়ায় বসে জমজমাটি আসর। কে নেই সেখানে? আশেপাশের গ্রাম হিজল, আন্দুলিয়া থেকে অসংখ্য মুসলিম মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। এক কথায় সম্প্রীতির মেলা। রাজ্য সড়কের ধার ধরে বসেছে ৯৫ টি দোকান । কথা বলছিলাম তাঁদের সঙ্গে যার ৯১ টির মালিক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। সম্প্রীতির বাঁধন। এই বাঁধন বেঁধে রাখে মনোহরপুরের আমজনতাকে। পুজোকে ঘিরে অনেকের রুটি, রুজির সংস্থান হয়। যারা বাইরে কাজ করেন সবাই এই সময় ঘরে ফেরেন। তাঁরা বাইরে থেকে টাকা রোজগার করে অর্থ নিয়ে ফেরেন। গ্রামের দোকানগুলিতে কেনাকাটা বেড়ে যায়। আক্ষরিক অর্থে লক্ষ্মী লাভ হয়। এই সম্প্রীতির সুরে বছরের বাকি সময় হাতে হাত রেখে সব ধর্মের, সম্প্রদায়ের মানুষ পথ চলেন। তাঁরা জুড়ে থাকেন আগামী বছরের লক্ষ্মী পুজোর পরিকল্পনা করে। আনন্দঘন মনোহরপুরে এই সবার বেঁধে বেঁধে থাকা আশেপাশের গ্রামবাসীদের মন জিতে নেয়। বা বলা ভালো ভালোবাসা দিয়ে মন হরণ করে। তাই তো লক্ষ্মী পুজোয় ভিড় জমান তাঁরাও।