সুমন শেখ, বহরমপুরঃ “বাংলাদেশের একজন কবি বলেছেন, জগত জুড়িয়া এক জাতি শুধু সে জাতির নাম মানুষজাতি। বাস্তবিকই পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতিকে নিয়ে এক মহাজাতি গঠনের স্বপ্ন কত আনন্দদায়ক । পৃথিবীতে কি তা কোনদিন হবে ? তা যদি নাও হয় তবু সে স্বপ্ন দেখার দোষ কি ?”। প্রতিবাক্যে মানুষের জয়গান আর স্পষ্ট আশাবাদ । ১৯৮৮ সালে ‘জঙ্গম’ পত্রিকায় “সাম্প্রদায়িক ঐক্য” শিরোনামে এক প্রবন্ধে উপরের কথাগুলি লিখেছেন অধ্যাপক রেজাউল করীম।

এই উচ্চারণের প্রতিধ্বনিই শোনা গেল রবিবার সকালে বহরমপুরে রেজাউল করীমের আবক্ষ মূর্তির সামনে অধ্যাপক আবুল হাসনাতের কন্ঠে । তিনি বললেন, “বাইরের আবরণকে ভুলে গিয়ে ভিতরের দিকে তাকাও, অন্তরের দিকে তাকাও। এই কথাই যুগেযুগে মনীষীরা বলেছেন। ‘ এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির, কাবা নেই’, মৌলনা জালাল উদ্দিন রুমি এই কথা বলেছেন। নজরুল ইসলাম বাংলায় এই উচ্চারণ করেছেন। মন্দির , কাবার এত বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে কিন্তু হৃদয় নির্বাসিত” । নির্বাসিত হৃদয়ে ভালোবাসা, মর্যাদায় আশ্রয় দিতে হবে। ফিরে যেতে হবে রেজাউল করীমের যাপন, লেখার কাছে। সম্প্রীতির সাধনায় নজর ফেরাতে হবে অন্তরের দিকেও , আহ্বান জানালেন প্রবীণ অধ্যাপক।

১৯৯৩ সালের ০৫ নভেম্বর প্রয়াত হন রেজাউল করীম। রাজনীতি আর সমাজে যখন বিভাজনের ঘনঘটা সেই রকম সময়ে সম্প্রীতির আহ্বান শোনা গেল বহরমপুরে রেজাউল করীম স্মরণে আলোচনায় । অধ্যাপক রেজাউল করীমের প্রয়াণ দিবসে রবিবার সকালে সম্প্রীতি পদযাত্রা হয় প্রগতিশীল নাগরিক মঞ্চের আহ্বানে। বিদ্যাসাগর স্ট্যাচুর মোড় থেকে এই পদযাত্রা শুরু হয়। জজকোর্ট , গোরাবাজার নিমতলা হয়ে মোহন মোড়ে শেষ হয় । সেখানে রেজাউল করীমের আবক্ষ মুর্তিতে মাল্যদান করেন বিশিষ্টজনেরা। রেজাউল করীম ও তাঁর চিন্তার উপর আলোচনা করেন এম সিরাজ, অধ্যাপক আবুল হাসনাত খান, অধ্যাপক সনৎ কর, অধ্যাপক অদিতি কুমার ধাওয়াল, মুর সেলিম, বিপ্লব বিশ্বাস সহ বিশিষ্টজনেরা। আলোচকরা বলেন, রেজাউল করীমের ভাবনায় প্রথম ও শেষকথা ছিল মানুষ । ছিল না বিচ্ছিন্নতার কোন স্থান। সম্প্রীতির সাধনায় বারবার ফিরে যেতে হবে রেজাউল করীমের কাছে। আলোচনায় যুদ্ধের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন বক্তারা। উঠে এসেছে অধ্যাপক রেজাউল করীমের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনার কথাও।

ড. জহর সেন রেজাউল করীম সম্পর্কে লিখেছেন, “ স্বাধীনতা, জাতীয়তা ও হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন” । তিনি আরও লিখেছন, “ ভারতের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা রক্ষার সংগ্রামে রেজাউল করীম ছিলেন আজীবন অহিংস সৈনিক”। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সের পড়ার সময়ই স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন রেজাউল করীম। তারপর দীর্ঘ জীবনজুড়ে জ্ঞানচর্চা থেকে যাপনে সম্প্রীতির সাধনায় ব্রতী থেকেছেন তিনি।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বহরমপুর শহরেই কাটিয়েছেন রেজাউল করীম। ১৯৯১ সালের ১০ আগস্ট দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আবুল বাশারের নেওয়া রেজাউল করীমের সাক্ষাৎকার। আবুল বাশার লিখেছেন, “সমন্বয় চিন্তার চিরপথিক তিনি। গান্ধীদর্শনে তাঁর দীক্ষা , করীমের মানস-বীক্ষণ-ভূমি অতন্দ্র ইতিহাস আর সাহিত্যের আলোয় মন্দ্রিয়- জীবনের নিত্যচর্যায় তিনি সন্তের মতো সহজ আর অনাড়ম্বর”। এদিন রেজাউল করীম স্মরণে আলোচনায় বিপ্লব বিশ্বাস আহ্বান জানিয়েছেন, আগামী দিনে আরও কর্মসূচী, আলোচনার মাধ্যমে রেজাউল করিম বিষয়ে চর্চা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।