মধ্যবঙ্গ নিউজ ডেস্ক, ৯ নভেম্বরঃ নেই মাথার ওপর কোনরকমের শক্ত ছাদ। ছাদ বলতে রয়েছে অন্তহীন নীল আকাশ। এবং বিছানা বলতে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের অধিগৃহীত বিস্তৃত জমি। খোলা আকাশের নীচে এক টুকরো প্লাস্টিক মুড়ি দিয়ে রাত কাটিয়ে দেন ৫০ বছরের প্রৌঢ়া। নাম কেউ জানেন না। এমনকি নিজের নামকি তিনি নিজেও বলতে পারলেন না। পড়নে রয়েছে হলুদ ফাটা নাইটি এবং তার নীচে নীল রঙের লুঙ্গি। উষ্কখুষ্ক চুল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ অনেকদিন ধরে স্নান করেনি এই প্রৌঢ়া। এবং সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ওনার বিছানা আর পাঁচটা বিছানার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ যে ইট দিয়ে বাড়ি বানানো হয়। সেই ইটের ওপর শুয়ে দীর্ঘদিন কাটিয়ে দেন ইনি। লোকে ‘পাগলি মাসি’ বলে ডাকে। তাঁর ঠিকানার কথা জিজ্ঞাস করাতে উত্তরে বলেন, ‘এই যে দেখছ, এটাই আমার ঠিকানা, আমর আস্তানা। আমার কাছে সমস্ত পৃথিবীটাই বাড়ি।’ এবং তাঁর কথা যে ‘খাঁটি সত্য’ সেটি প্রৌঢ়ার বর্তমান অবস্থান দেখলেই বোঝা যায়।
কিন্তু এই সবকিছুর মধ্যে প্রৌঢ়ার চমকে দেওয়া কাণ্ডের খবর পেয়ে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার জাতীয় সড়ক সংলগ্ন বেসরকারি গাড়ি স্ট্যান্ডের উল্টো দিকে নির্মীয়মাণ জাতীয় সড়কে ভিড় জমেছে সাধারণ মানুষের। অসমাপ্ত হয়ে পড়ে থাকা জাতীয় সড়কের একটি লেন এবং তার সংলগ্ন বিশাল এলাকা জুড়ে ধান ফলিয়েছেন ওই ‘পাগলি মাসি’।
দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের যোগাযোগের অন্যতম সড়কপথ ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। ‘ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’র উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের বরাদ্দ অর্থে বেশ কয়েক বছর আগেই শুরু হয়েছে ওই জাতীয় সড়কের আরও দু’টি লেন সম্প্রসারণের কাজ। জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল প্রায় দু’দশক আগে। অধিগৃহীত জমিতে দখলদারি যাতে না হয়, তার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। তার পর থেকে থমকে রয়েছে কাজ। এখন একটু বৃষ্টিতেই ওই এলাকায় জল জমে যায়। চলাচলের অসুবিধা হয়। চলতি বর্ষাতেও জল জমেছিল। সেই জল একটু সরে যেতেই সেখানে আস্তানা গাড়েন মহিলা। সেখানেই তিনি ফলিয়েছেন ধান।
কিন্তু প্রশ্ন কীভাবে এটা হল? স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, কোথাও থেকে ধানের চারা জড়ো করে চারিদিকে রোপণ করে দিয়েছিলেন ‘পাগলি মাসি’। এবং এই জাতীয় সড়কের পাশেই পরে থাকা গোবরকে সার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। প্রথম প্রথম তাঁর কীর্তিকলাপ দেখে হাসতেন সাধারণ পথ চলতি মানুষ থেকে আশেপাশের দোকানদারেরা। তবে কেও কোনোদিন বাঁধা দিতে আসেনি তাঁকে। আর মহিলাও আপন খেয়ালে নিজের মতন প্রতিদিন ধান চাষ করে গিয়েছেন। যেন উনি জানতেন কীভাবে চাষ করতে হয়। জানতেন এই মাতিতেও প্রাণ আছে। জন্মাতে পারে ধান। এই কাজ অভিজ্ঞ মানুষ ছাড়া করা মুশকিল বলে জানাচ্ছেন কৃষিবিদরা। কয়েক দিন আগে নিম্নচাপের বৃষ্টিতে সবুজে মুড়ে গিয়েছে অর্ধসমাপ্ত জাতীয় সড়ক। বিশাল রাস্তার মাঝখানে আচমকা বিশাল জায়গা জুড়ে ধানগাছ দেখে অবাক হয়েছেন স্থানীয়রা।
বছর পাঁচেক আগে থেকে ঠিকানা বলতে বেলডাঙার বাসস্টান্ড সংলগ্ন এলাকা। কয়েক বছর ধরেই সেখানেই ঠাই হয়েছে ভব ঘুরের। লোক জনের সাথে কথা তিনি বলেন না। তবে সকাল দুপুর কোন দোকান বা হোটেলে খাবার দিয়েই চলে তাঁর পেট। এই ভাবেই সচারচর তাঁর দিন কাটে এমন টাই জানান রাস্তার ওপারে থাকা খাবারের দোকানের মালিক।
যে পরিমান ধান চাষ করেছেন তাঁর অর্ধেক কেটে বস্তায় পুরে রেখেছেন ওই ভবঘুরে। ভব ঘুরেই এহেন কাজে হতবাক এলাকার ব্যবসায়ী থেকে স্থানীয়রা। এখনও পাকা ধান কাটা বাকি রয়েছে বেশ কিছুটা অংশে। তবে সেই পাকা ধান পাহারার সারাক্ষন জমির পাশেই বসে রয়েছেন তিনি। কীভাবে এই ধান চাষ করলো তা দেখে হতবাক সকলেই।
ইতিমধ্যেই কয়েক বস্তা ধান তুলে ফেলেছেন পাগলি মহিলা। বাকি ধানও হয়তো কিছু দিনের মধ্যে তুলে নেবে। তবে নাম না জানা মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলার নাম ডাক এখন সবার মুখে মুখে। কিন্তু আমাদের মতন মানুষদেরও বুঝতে হবে এই সমস্ত ভারসাম্যহীন মানুষেরাও পারেন কিছু অসামান্য কাজ করতে।