মুর্শিদাবাদ ফেরাতে শাসকের আস্থা শাওনীতে, ফরাক্কা উদ্ধারে ভরসা প্রাক্তন সিপিএম নেতাকে
নিজস্ব প্রতিবেদনঃ জঙ্গিপুরে জাকির হোসেনের জেদের কাছে হার মানলেন খলিলুর রহমান। মুর্শিদাবাদ বিধানসভা আসন পুনরুদ্ধারের জন্যে আস্থা শাওনী সিংহরায়ের অনুগামীদের উপর। লোকসভা ভোটে অনেকটাই পিছিয়ে থাকা ফরাক্কায় ভরসা প্রাক্তন সিপিএম নেতা আব্দুস সালাম। সাগরদিঘির গোষ্ঠী কোন্দলে জেরবার অবস্থা থেকে বেরোতে বিধায়কের নেতৃত্বে কোর কমিটি। গত লোকসভায় অনেকটাই পিছিয়ে থাকা লালগোলায় জেলা পরিষদ সদস্য মহিলা নেত্রী টিম রুমা ব্যানার্জিকে দায়িত্ব। শহর বহরমপুর পুনরুদ্ধারের জন্যে পুরপিতা নাড়ুগোপাল মুখার্জিতে আস্থা রাখলেও ছায়ার মতো জুড়ে দেওয়া হয়েছে আরেকজনকে। বেশ কয়েক বছর রাজনীতি থেকে অন্তরালে চলে যাওয়া অধীর চৌধুরীর প্রাক্তন শ্যালক ডাকসাইটে নেতা অরিত মজুমদারকে। ভরতপুরের বিতর্কিত বিধায়ক হুমায়ুন কবীরের দাবি মতো জেলা কমিটিতে পুনর্বাসন দিয়ে সরানোর চেষ্টা ভরতপুরে দুই ব্লকের সভাপতিকে। সংঘাতের আশঙ্কায় আপাতত স্থগিত ভরতপুরের ব্লক সভাপতি সহ অন্যান্য গণ সংগঠনের পদাধিকারীদের নাম ঘোষণা। শেষ পর্যন্ত নবগ্রাম বিধায়কের জেদাজেদির কাছে বশ্যতা টিএমসি নেতৃত্বের। বিধায়ক ঘনিষ্ঠ এনায়েতোল্লা থেকে গেলেন নবগ্রামের ব্লক সভাপতি। তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, পরিছন্ন ভাবমূর্তির জেলা যুব সভাপতির পক্ষ থেকে কলকাতায় অভিষেক ব্যানার্জির মিটিংয়ে প্রকাশ্যে নবগ্রাম ব্লক সভাপতির বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ জানানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেই দাবি আমল পেল না এক সময়ের নবগ্রামের দাপুটে কৃষক নেতা, বিধায়ক কানাই মণ্ডলের আর্জির কাছে।
Murshidabad TMC: যদিও হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামত শেখ শেষ পর্যন্ত ব্লক সভাপতির পদে তাঁর ঘনিষ্ঠ লোককেই বসালেন। তিনি জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ ও তাঁর বাহিনীর দিকে কঠিন চালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন হরিহরপাড়ার মাটিতে। ভগবানগোলার বিধায়ক দুই ব্লক সভাপতিকেই সরিয়ে মাস্টারস্ট্রোক খেললেন ২৬-এর ভোটের আগে। রেজিনগর বিধানসভায় ঘোষিত তিন ব্লক সভাপতি যে বিধায়ক রবিউল আলম চৌধুরীর সঙ্গে মধুর সম্পর্ক রেখে চলবেন না, এটা প্রায় স্পষ্ট। আর ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন রবিউল। তাঁর দাবি, সরাতে হবে বেলডাঙা ২ নম্বর পূর্ব ব্লক সভাপতি মাঞ্জুর শেখকে। কারণ তিনি খুনের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আত্মগোপনে। ওই ভাবমুর্তির লোকের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ। এটাই এক ঝলকে তৃণমূলের সাংগঠনিক রদবদলের টুকরো কোলাজ।
বিধানসভা ভোটের আগে মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলে বড় রদবদল হল। একাধিক ব্লক সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়া হল। দুর্গাপুজোর মুখে যে ঘটনায় গুঞ্জন জেলাজুড়ে। মহালয়ার আগের দিন শনিবার সন্ধ্যায় তৃণমূলের তরফে নতুন তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। নেতৃত্ব বাছতে জটিল পরিস্থিতি সাগরদিঘি, লালগোলা ও বহরমপুরে। সেখানে কোর কমিটি তৈরি করতে হয়েছে। সেই কমিটি বাছতে এমন অবস্থা হয়েছে যে ‘ডি ফ্যাক্টও সদস্য’ বলেও উল্লেখ রাখতে হয়েছে। যা নিয়ে জেলার রাজনৈতিক মহলে নানারকম আলোচনা শুরু হয়েছে। আবার যাঁদের সভাপতি হওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁদের গোষ্ঠীর মধ্যে কানাকানি শুরু হয়েছে। ঘটনায় চাপা মন কষাকষি শুরু হয়েছে একাংশের মধ্যে। আগামী বিধানসভা ভোটে এর ফলে কারা টিকিটে কল্কে পেতে পারেন তা নিয়ে জেলাজুড়ে চর্চা শুরু। মুর্শিদাবাদ-বহরমপুর সাংগঠনিক জেলায় সরিয়ে দেওয়া হল ভগবানগোলা ১ নম্বর ব্লক, ভগবানগোলা ২ নম্বর ব্লক, রানীনগর ১ নম্বর ব্লক, মুর্শিদাবাদ (লালবাগ), আজিমগঞ্জ জিয়াগঞ্জ, বড়য়া দক্ষিণ, কান্দি শহর, বেলডাঙ্গা ২ পশ্চিম, বেলডাঙ্গা ১ দক্ষিণের ব্লক সভাপতিকে। তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলার ফরাক্কা ব্লক, সামশেরগঞ্জ ব্লক, ধুলিয়ান শহর, সুতি ২ নম্বর ব্লক, জঙ্গিপুর পূর্ব শহর, জঙ্গিপুর পশ্চিম শহরের ব্লক সভাপতিকে।
Murshidabad TMC: কোন অঙ্কে এই সভাপতি বদল হল তা নিয়ে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রে জয় পায় কংগ্রেস। কংগ্রেসের বড় অঙ্কে জয় ছিল ফরাক্কায়। এই আসনে লোকসভায় কংগ্রেস পেয়েছিল ৮৭ হাজার ৭৬৫টি ভোট। ফরাক্কায় কার্যত তৃতীয় হয় তৃণমূল। তৃণমূলের শাহনওয়াজ আলি রাইহান পেয়েছিলেন ৩৬ হাজার ৯৩১ টি ভোট। দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিজেপি।
অথচ ২০২১ সালের বিধানসভায় ফরাক্কায় জয়ী হন তৃণমূল বিধায়ক মণিরুল ইসলাম। তিনি জনসমর্থন পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ২ হাজার ৩১৯ জনের। বিজেপির হেমন্ত ঘোষ পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ৩৭৪ জনের। কংগ্রেসের মইনুল হক পেয়েছিলেন ৩৬ হাজার ২০৫ জনের ভোট। হেরে যাওয়ার পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হক। মইনুল ঘনিষ্ঠ মহম্মদ আব্দুস সালামকে ফরাক্কায় তৃণমূলের ব্লক সভাপতি করা হয়েছে। আব্দুস সালামও সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ফরাক্কায় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে অরুণময় দাসকে। তিনিও সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন।
Murshidabad TMC: এদিকে মুর্শিদাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রে শাসকদল শাওনি সিংহরায়ের উপর আস্থা রাখল। তাঁর অনুগামীদের তৃণমূলের ব্লক ও শহর সভাপতি করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ বিধানসভা এলাকার আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জের সভাপতি করা হয়েছে শাওনীর রাজনৈতিক অনুগামী প্রসেনজিত ঘোষকে। ওই মুর্শিদাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রে গত বিধানসভা ভোটে হেরে যান তৃণমূল প্রার্থী শাওনী। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৯৩ হাজার ৪৭ টি। সেখানে জয়ী হন বিজেপি বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ। তিনি ভোট পান ৯৫ হাজার ৩৩০ টি। কংগ্রেসের নিয়াজুদ্দিন সেখ ভোট পেয়েছিলেন ২৮ হাজার ৬৯৮ টি। গত লোকসভা আসনে এই বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি পায় ৯৪ হাজার ১৬৪টি ভোট। তৃণমূল পায় ৮৬ হাজার ৩১৩টি ভোট। সিপিএম পেয়েছিল ৪০ হাজার ৬৫১ টি ভোট।
এদিকে সাগরদিঘি ও লালগোলায় নতুন সভাপতির নাম চূড়ান্ত করতে পারল না শাসক দল। জটিল পরিস্থিতি বহরমপুরে। লালগোলায় বিধানভা ভোটে জয়ী হন তৃণমূলের আলি মহম্মদ। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৭৭ হাজার ৩ টি। দ্বিতীয় হয়েছিলেন কংগ্রেসের আবু হেনা। তিনি ভোট পেয়েছেন ৪৬ হাজার ৮৯১ টি। বিজেপির কল্পনা ঘোষ পেয়েছিলেন ২৯ হাজার ৩৪০টি। সাগরদিঘিতে গত বিধানসভা ভোটে জয়ী হন তৃণমূলের সুব্রত সাহা। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৯৪ হাজার ৮৮০টি। দ্বিতীয় হয়েছিলেন বিজেপির মাফুজা খাতুন। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৪৪ হাজার ৬৯২টি। তৃতীয় হন কংগ্রেসের সেখ এম হাসানুজ্জামান। সাগরদিঘিতে সুব্রত সাহার প্রয়াণের পর জয়ী হন কংগ্রেসের বাইরন বিশ্বাস। যাতে সাড়া পড়েছিল। রাজ্যে কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ক হয়েছিলেন। তবে তিনিও পরে তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। বহরমপুরে জয়ী হন বিজেপির সুব্রত মৈত্র। তিনি ভোট পান ৮৭ হাজার ৭৫৯ টি। দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন তৃণমূলের নাড়ুগোপাল মুখার্জি। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৬১ হাজার ৮৩৫ টি। তৃতীয় স্থানে ছিলেন কংগ্রেসের মনোজ চক্রবর্তী। তিনি ভোট পেয়েছিলেন ৩৯ হাজার ৩৭৭ টি। বহরমপুর দখলে এখনও কারা সামনে থাকবেন তা চূড়ান্ত করতে পারল না শাসকদল।
এক ঝলকে কোন ব্লকে বদল তৃণমূলের ব্লক সভাপতি
তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলার
ফরাক্কা ব্লকে নতুন সভাপতি হয়েছেন সিপিএম থেকে আসা মহম্মদ আব্দুস সালাম।
সামশেরগঞ্জ ব্লকে নতুন সভাপতি হয়েছেন মহম্মদ জাকির হোসেন।
ধুলিয়ান শহরে নতুন সভাপতি হয়েছেন কওসর আলি।
সুতি ২ নম্বর ব্লকে নতুন সভাপতি হয়েছেন মহম্মদ মাসুদ রানা।
জঙ্গিপুর পূর্ব শহরের নতুন সভাপতি হয়েছেন রেজাউল করিম।
জঙ্গিপুর পশ্চিম শহরের নতুন সভাপতি হয়েছেন বামাপদ দাস।
জটিল পরিস্থিতি সাগরদিঘিতে। সেখানে করা হয়েছে কোর কমিটি। বিধায়ক বায়রন বিশ্বাসকে চেয়ারপার্সন। এছাড়া কোর কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, দেবাশিস বানার্জি, ইস্তিয়াক আহমেদ, কিস্মত আলি, রেজাউল্লা শেখ, সামসুল হুদা, তাপস রাজা ভকত। লালগোলাতেও কোর কমিটি করা হয়েছে। সেখানে আহ্বায়ক করা হয়েছে রুমা বানার্জিকে (বাহাদুরপুর ও বিলবোরাকোপরা)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, সেলিম আখতার আপেল (কালমেঘা ও পাইকাপারা), মোতাহার হোসেন রিপন (রামচন্দ্রপুর), তাজামুল হক ভুট্টু (মানিকচক), হজরত আলি (নসিপুর ও মাইয়া), মহম্মদ নূরামিন (জসাইতলা), মিনারুল ইসলাম অরফে রকি (দিওয়ান সরাই ও আয়িরমারি কৃষ্ণপুর), মহম্মদ ফারুক আব্দুল্লা (লালগোলা)।
তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার
ভগবানগোলা ১ নম্বর ব্লকে নতুন সভাপতি হয়েছেন ইমরান হোসেন প্রামাণিক।
ভগবানগোলা ২ নম্বর ব্লকে সভাপতি হয়েছেন গোলাম সাদিয়ার (দুলাল)।
রানীনগর ১ নম্বর ব্লকে নতুন সভাপতি হয়েছেন আশরাফুল হক।
মুর্শিদাবাদের (লালবাগ) তৃণমূল সভাপতি হয়েছেন শুভাশিস সরকার (সঞ্জু)।
আজিমগঞ্জ জিয়াগঞ্জের নতুন সভাপতি হয়েছেন প্রসেনজিত ঘোষ।
বড়য়া দক্ষিণের নতুন সভাপতি হয়েছেন মাহে আলম।
কান্দি শহরের নতুন সভাপতি হয়েছেন দেবল দাস।
বেলডাঙ্গা ২ পশ্চিমের সভাপতি হয়েছেন সন্দীপ ঘোষ।
বেলডাঙ্গা ১ দক্ষিণের সভাপতি হয়েছেন হাসান মন্ডল।
বহরমপুর শহরেও করা হয়েছে কোর কমিটি। এর আহ্বায়ক করা হয়েছে বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নাড়ুগোপাল মুখার্জিকে। ওই কমিটির প্রত্যেককে বিভিন্ন ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে রয়েছেন বাবন রায় (১,২,৯,১৬ ওয়ার্ড), অরিত মজুমদার (৩,৪,৫,৬,৭,১২), অপর্ণা শর্মা (৮, ১১), শুভদ্বীপ চ্যাটার্জি (১০, ১৩, ১৪, ১৮)। সাহালম সেখ (১৫, ১৭, ২০, ১৯)। রাম নাগ (২১, ২২)। হিন্দোল রায়চৌধুরি (২৩, ২৬, ২৭)। জয়ন্ত প্রামাণিক (২৪, ২৫, ২৮)।