প্রতিদিন খেয়ে চলেছি প্লাস্টিক! বিশ্ব পরিবেশ দিবসের বার্তা কী?

Published By: Madhyabanga News | Published On:

উন্মেষ মিত্র, পরিবেশপ্রেমী: আমরা প্রতিদিন কি কি খাবার খেয়ে থাকি? ভাত-রুটি-মুড়ির সাথে আমাদের কারর পছন্দ কালো জিরে দিয়ে পাতলা মাছের ঝোল, কারর পাতে বেশ ঝাল ঝাল করে মাংস, কেউ বা নিরামিষ ভোজনেই স্বছন্দ। খাদ্যাভ্যাস যার যাই হোক না কেন, আমাদের সকলের খাদ্য তালিকায় অজান্তে ঢুকে পড়েছে আরেকটি উপাদান। সেটি খাদ্য উপাদান না হলেও আমরা প্রতিদিন সেটিকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে চলেছি। মনে মনে ভাবছেন যে, কি এমন জিনিস হতে পারে যা আমরা জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা নির্বিশেষে প্রতিদিন খেয়ে চলেছি? উত্তরটা হল, আমাদের সবার অতি পরিচিত ‘প্লাস্টিক’। খুব সঠিক ভাবে বলতে গেলে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’।

মাইক্রোপ্লাস্টিক মানে প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ যা খালি চোখে দেখা যায় না, এদের দর্শন পাওয়া যায় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে। আমরা প্রতিদিন যে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করি, অথবা দোকান থেকে যে প্লাস্টিকের থলিতে দুধ কিনি, শিশুমন ভোলানো লজেন্সের ওপর যে প্লাস্টিকের মোড়ক, সে সব কিছুই ক্ষয় পেতে পেতে, ভাঙতে ভাঙতে আণুবীক্ষণিক মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়। তারপর জলজ জুপ্ল্যাঙ্কটন (আণুবীক্ষণিক প্রাণী) খাদ্য হিসাবে নিজেদের অজান্তে গ্রহণ করে একে, সেখান থেকে ছোটো পোকা, বড় পোকা, ছোটো মাছ, বড় মাছ, তার তারপর বাজারের সেই বড় মাছ দাম-দর করে বাড়িতে নিয়ে এসে আলু-বড়ির ঝোলের সাথে আপনার পেটে। এই ভাবে খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে জুপ্ল্যাঙ্কটন থেকে মানুষের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের যাত্রা পথে বাড়তে থাকে এর আয়তন।

সহজ ভাবে বোঝার জন্য ধরুন, একটি জুপ্ল্যাঙ্কটন ১ ইউনিট মাইক্রোপ্লাস্টিক খেয়ে থাকে, আর একটি ছোটো পোকা ১০০ টি জুপ্ল্যাঙ্কটন খায়, তাহলে ছোটো পোকার শরীরে ১০০ ইউনিট মাইক্রোপ্লাস্টিক জমা হল, এবার একটি বড় পোকা ১০০ টি ছোটো পোকা খেলে তার শরীরে জমা হয় ১০০×১০০=১০০০০ ইউনিট মাইক্রোপ্লাস্টিক। এবার তাহলে মানুষ পর্যন্ত হিসেবটা আপনারাই করে ফেলুন। বিজ্ঞানের ভাষায় এই ঘটনা ‘Bioaccumulation’ নামে পরিচিত। এখানে শুধু মাত্র একটি খাদ্য শৃঙ্খলের উদাহরণ দিলাম, মাছ, মাংস, এমনকি ডিমের মধ্যেও সন্ধান পাওয়া গেছে এই খুদে আতঙ্কের! নিরামিষভোজী মানুষজন এতদূর পড়ে নিশ্চয় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছন।

দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী যে, আপনাদের স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী করতে আমি অক্ষম। ২০২১ সালে ‘ন্যানোমেটিরিয়াল’ নামক পত্রিকায় যে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সেখানে দেখা গেছে সে মাটিতে অবস্থিত ‘ন্যানোপ্লাস্টিক’ (যেটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের থেকেও আকারে ছোট) এবং ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ জল এবং খনিজ লবণের সাথে মূলের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে উদ্ভিদ দেহে। জমা হয়েছে মূল, কান্ড, পাতা এমনকি ফলের মধ্যে। ২০২০ সালে ইতালির সিসিলি অঞ্চলের কাতানিয়ার একটি বাজার থেকে সংগ্রহ করা সবজি, ফলের মধ্যে এই খুদে আতঙ্কের সন্ধান পেয়েছেন বৈজ্ঞানিকরা। চমকের শেষ এখানেই নয়, ২০২০ সালে ইকুয়েডরের বৈজ্ঞানিকরা প্লাস্টিকের সন্ধান পেয়েছেন দুধ, বোতলজাত ঠান্ডা পানীয় এমন কি মধুতে!

ভয় লাগছে? গলা শুকিয়ে আসছে? জল খেতে মন চাইছে? খেয়ে নিন। তবে এখানেই সব থেকে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এই দল কলকাতা শহরের ২০০ টি আলাদা আলাদা জায়গা থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করেন এবং তারপর পরীক্ষাগারে চলে বিশ্লেষণ। এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে ২০২৩ সালে। দেখা গেছে ৯০% পানীয় জলের নমুনা তে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ এর উপস্থিতি।

এর ফলাফল কি? ডাক্তারদের কথা অনুসারে এই ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ হল নিশব্দ মৃত্যুদূত। এর উপস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লিভার, ব্যাহত হয় কিডনির কাজ। প্রচুর পরিমানে প্লাস্টিক শরীরের প্রবেশ করলে ক্ষিদে কমে যায়, আর অদূর ভবিষ্যতে হতে পারে ক্যান্সারের কারণ।

আজ ৫ ই জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবছর এই দিনের মুখ্য বার্তা #BeatPlasticPollution. প্রকৃতি বড়ই নির্লোভ। আমরা তাকে যা দেব, সে আমাদের কোনো না কোনো মাধ্যমে ফিরিয়ে দেবে। আমরা অবহেলায় প্লাস্টিকের পাহাড় গড়ব, প্রকৃতি আমাদের শরীরেই তা ফিরিয়ে দেবে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ হিসাবে। আবার আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে যদি প্রকৃতির ক্ষত মেরামতে হাত লাগাই, সেও ফিরিয়ে দেবে বিশুদ্ধ জল, পরিপোষক খাদ্য, নির্বিষ শ্বাসবায়ু। শপথ নিন, সচেতন হন, অপরকে সচেতন করুন। শুধু ৫ই জুন নয়, আমাদের মননে-চিন্তনে বছরের প্রতিটি দিন হয়ে উঠুক পরিবেশ দিবস।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)