ঋত্বিক দেবনাথ, বহরমপুরঃ চিনাবাদাম খেলে যেমন পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে, তেমনই শরীরে বিভিন্ন উপকারও করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি খেলে বাদামের মতো উপকার পাওয়া যায় আর এর দামও বেশ সস্তা। সেই পুষ্টিকর খাবারই ঢালাও বিক্রি হচ্ছে বহরমপুরে রাস্তার ধারে। বিক্রি করছেন আলিগড় থেকে আগত দুইজন। সম্পর্ক তাদের দাদা এবং ভাইয়ের। বড়দাদা-এর আগেও বহরমপুর এসেছিলেন এই ব্যবসা সূত্রে। কিন্তু তার ভাই যার বয়স মাত্র এগারো বছর। সে প্রথমবার কাজের সূত্রে নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে প্রায় ১২৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি শহর বহরমপুরে পারি দিয়েছে।
এবং সে এখন পড়ছে ক্লাস ফাইবে। আলিগড়ের একটি গ্রামীণ সরকারি স্কুলে সে পড়াশোনা করে। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রচণ্ড ভালোবাসে খেলাধুলা করতে। কিন্তু সংসারের চাপে সেই ছোট্ট কাঁধে চেপে যায় দায়িত্বের পাহাড়। মোট সাত ভাইবোন তার। পরিবারের সবচেয়ে ছোট্ট সদস্য সে। বাড়িতে রয়েছেন বাবা-মা। ওঁনারাও সময় অসময়ে বাইরে কাজ করতে যান। তাই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে বড় দাদা শাহানোয়াজ আব্বাসের সঙ্গে বহরমপুরে এসেছে। চিনাবাদাম বিক্রি করতে।

যেমন যেকোনো ব্যবসার সময় বা সিজিন থাকে তেমনই এই ব্যবসারও রয়েছে। এমনটাই জানালেন দাদা শাহানোয়াজ আব্বাস। তিনি জানান, “শীতের সময় সচারচর আমাদের এই ব্যবসার শুরু হয়। তাই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই আমি ও আমার ভাই এসেছি। আর কিছুদিন থাকব। ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হলেই বাড়ি ফেরত চলে যাব।”
আব্বাস দীর্ঘদিন ধরে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। ছোট থেকে সে ও বাইরে বাইরে কর্মরত। ফলে ক্লাস নাইনের পর আর স্কুল যাওয়া হয় নি তার। এরপর দিল্লীতে অটো চালক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু দু’বছর আগে সেখানে অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় শরীর খারাপ হয়ে যায়। ফলে আব্বাসের শরীরে বাঁ দিক পঙ্গু হয়ে যায়। দীর্ঘ দু’বছর অসুস্থ থাকার পর এই বছর আবার কাজে ফেরত এসেছেন তিনি। কিন্তু এখনও সম্পূর্ণভাবে সুস্থ না হওয়াই সাহায্যের অতিরিক্ত হাত হিসেবে নিয়ে এসেছেন ছোট্ট ভাইকে।
ক্লাস ফাইভের ফাইনাল পরীক্ষায় এবার বসা হল না আব্বাসের ভাইয়ের। পড়াশোনা করতে করতে হঠাত বন্ধ করতে হয়। যদিও আবার বাড়ি ফিরে স্কুলে ভর্তি নেবে নাকি, সেই নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে ক্রমাগত ভারি লোহার হাতা নাড়িয়ে যাচ্ছে সে। কষ্ট হচ্ছে না? জিজ্ঞাসা করায়, উত্তরে এল “না, এখন আর হয় না। প্রথম কিছুদিন খুব হাত ব্যাথা করেছে। কিন্তু এখন কাজ করতে করতে সবকিছুই সহ্য হয়ে গিয়েছে।” আর সেই হাতা যদি না নাড়ানো হয় তাহলে পুড়ে যাবে সেই চিনাবাদাম। যাতে না পোড়ে তাই ক্রমাগত নাড়াতে হয়।
ইতিমধ্যে ১৫ বস্তা মাল বিক্রি করে ফেলেছেন তাঁরা। প্রতি বস্তা সমান চল্লিশ কেজি। ২৫০ গ্রামের দাম ৫০ টাকা এবং ২০ টাকা ১০০ গ্রামের দাম। আব্বাস হিসেব করে বললেন, এই কয়েক মাসে ১৫ হাজার টাকার লাভ করে ফেলেছেন দুইভাই মিলে। আলিগড়ে এই চিনাবাদামের ব্যবসা করলে এত লাভ হয় না বলে জানান আব্বাস। ভাইকে এইবার নিয়ে আসার একমাত্র কারণ তার শরীর এখনও দুর্বল।
মুর্শিদাবাদের মতন প্রান্তিক জেলা। যেখানকার কিছু সংখ্যক মানুষ পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। সেই জেলাতেও বাইরে থেকে আসেন মানুষ কাজের খোঁজে। এটাই হয়ত প্রকৃতির নিয়ম। যেখানে যে ফসলের ফলন বেশি সেখানে তার দাম তত কম। এই কথায় উঠে এল আব্বাসের থেকেও। তিনি এই বিষয়ে জানান, “এই এলাকায় আমরাই খালি বিক্রেতা। যদি আমাদের আলিগড়ে যাওয়া হয় তাহলে সেখানে এই টুকু জায়গাতে আরও ১০-১৫ জন ব্যবসাদার বসে যাবে। কারণ ওখানে মানুষ চিনাবাদাম বেশি পরিমাণে খায়। এখানে কম খায় কিন্তু দিনে ৫০০-৬০০ টাকার বিক্রি হয়। আমাদের ওখানে ২৫০ টাকা প্রতিদিন বিক্রি হবে নাকি সন্দেহ।”















