ঋত্বিক দেবনাথ, বহরমপুর: বছর ষাটের অখিলানন্দ মুখার্জি। পেশায় তিনি ছিলেন শিক্ষক। দীর্ঘ কুড়ি বছর এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। নিজের হাতে পাঠ দিয়েছেন পড়ুয়াদের। শিখিয়েছেন অক্ষর পরিচয় থেকে যোগ বিয়োগ।
কিন্ত কখনও মুখই দেখতে পাননি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের। তবে আঁধার কাটিয়েছেন। আসলে অখিলানন্দ বাবু নিয়েও আশৈশব সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টিহীন। পৃথিবীর আলো কেমন হয়, কোনদিন দেখেন নি তিনি । নিজের চোখে দেখতে পেলেও ছাত্রছাত্রীদের দিয়েছেন আলোর সন্ধান।
হাজার প্রতিকূলতা কাটিয়ে, আজও সমাজে সচেতনতার বার্তা দিয়ে চলেছেন অখিলানন্দ মুখার্জি। তিনি জানাচ্ছেন , “আমাকে যিনি আলো দেখিয়েছেন তিনিও একজন দৃষ্টিহীন। তিনি আমাকে ১৯৫৮ সালে বেহালা ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি করান। তারপর আমার ধীরে ধীরে মাধ্যমিক পাশ করা। পরে বেলডাঙা কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশান শেষ করি” ।
তবে কলেজে পড়ার সময় থেকেই ইচ্ছে ছিল দৃষ্টিহীন এবং অনান্য প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করবেন। সেই মতো ঝুনকা গ্রামে সাধারণ মানুষের সাহায্যে ১৯৯১ সালে তৈরি করে ফেললেন ‘ঝুনকা প্রতিবন্ধী আলোক নিকেতন’ নামে একটি স্কুল।
এই স্কুলেই দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন তিনি। দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন কীভাবে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করা যায়। অক্ষর চেনা যায়। শিখিয়েছেন সহজে যোগাযোগ গড়ে তোলার পদ্ধতি।
বিশ্ব ব্রেইল দিবসে উঠে এল মুর্শিদাবাদ জেলার বেলডাঙা থানার অন্তর্গত ঝুনকা গ্রামের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে লড়াই’এর ঘটনা । প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের ৪ই জানুয়ারি বিশ্ব ব্রেইল দিবস পালিত হয়। দৃষ্টিহীন ও স্বল্প দৃষ্টিহীন মানুষের অধিকারের কথা মনে করিয়ে দিতেই এই দিনটির উদযাপন।
এই ব্রেইল পদ্ধতির আবিষ্কর্তা লুইস ব্রেল। এই পদ্ধতিতে ছয়টি ডট বা ফুটকুরি সাহায্যে সবকটি সংখ্যা ও অক্ষর প্রকাশ করা হয়। এই ব্রেইল পদ্ধতির ব্যবহার করে বহু দৃষ্টিহীন মানুষ আজ নিজেদের পড়াশোনা চালাচ্ছেন । নিজেদের জীবনের স্বপ্ন বা ইচ্ছে পূরণ করতেও সক্ষম হচ্ছেন অনেকেই ।
ব্রেইলের জনক লুইসের জন্মদিনটিকে ঘিরেই পালিত হয় এই বিশেষ দিন। ২০১৯ সালে জাতিপুঞ্জ প্রথম এই দিনটিকে বিশ্ব ব্রেইল দিবস হিসেবে পালন করা শুরু করে। এবং এই বছরের থিম “সাইট উইদাউট সিয়িং”।
এই ব্রেইল পদ্ধতিকে হাতিয়ার করে অখিলানন্দ মুখার্জি পড়িয়েছেন শতাধিক দৃষ্টিহীন পড়ুয়াকে । বর্তমানে ঝুনকা প্রতিবন্ধী আলোক নিকেতন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক লক্ষন মুখার্জি । তিনি জানান, “আমাদের স্কুলে বর্তমানে ৪৬ জন পড়ুয়া রয়েছে। এবং আজকের এই বিশেষ দিনটি পালন করার জন্য আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদের জন্য নতুন বই, খাতা, স্কুল ব্যাগ, জুতো। এই সমস্ত জিনিস দিচ্ছি”। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন দার্শনিক জেরেমি বেনথামের উক্তি , “দা গ্রেটেস্ট গুড ফর দা গ্রেটেস্ট নাম্বার”। অর্থাৎ আপনি একটি ভালো কাজ করলে সেই কাজটি আরও একটি ভালো কাজের সংখ্যার সঙ্গে যোগ হবে। লক্ষণবাবু বলেন, “ আমরা সাধারণ মানুষ যদি একটি প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে সেও সাহস পাবে আরও একজনের পাশে এসে দাঁড়াতে” ।