‘পুরনো সেই দিনের কথা সে কি ভোলা যায়’
সুব্রত মুখার্জী আমাদের কাছে অভিভাবক ছিলেন। ৭০এর দশকে প্রিয় সুব্রত একটা আবেগের নাম ছিল, আমরা আবেগে ছুটতাম। ওনার মাথার উপরে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বাংলার রাজনীতিতে নতুন করে ছাত্র পরিষদ কংগ্রেস দলকে ক্ষমতায় নিয়ে এলো। প্রিয় সুব্রত র নেতৃত্বে। সুব্রতদার সাথে আমাদের পরিচয় বহু দিনের। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি খুব স্নেহ করতেন ভালো বাসতেন।
এই বহরমপুর তাঁর কাছে খুব আবেগ প্রবণ ছিল। মন্ত্রী হবার পর এখানে অষ্টম রাজ্য সম্মেলন হয়েছিল ছাত্র পরিষদের। সুব্রত সাহা ছিলেন তখন মুর্শিদাবাদ জেলা ছাত্র পরিষদের সভাপতি। অষ্টম রাজ্য সম্মেলনের পরে ১৯৭৩ সালের ৩রা অক্টোবর সপ্তমীতে বিকেল তিনটের সময় ছাত্র পরিষদের জেলা কার্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন এবং আমাদের জেলা ছাত্র পরিষদের ভবন তৈরীর কাজ শুরু হল। এখানে সুব্রত মুখ্যার্জী এসে আমাকে জেলা ছাত্র পরিষদের সভাপতি করলেন। তারপর এখানে আমরা কাউন্সিলর হবার পর এখানে এসে চেয়ারম্যান হিসাবে প্রদীপ মজুমদার ও আমাকে পূর্ত দপ্তরের দায়িত্ব দিয়ে এখানে কংগ্রেসের পৌর বোর্ড গঠন করে যান । কদিন আগেও সুব্রতদার সাথে কথা হল, ভাবতেই পাড়া যাচ্ছে না । মৃত্যুর আগে অধীর চৌধুরীর সাথে তাঁর কথাবার্তা হয়েছে । স্বাভাবিক কথাবার্তা । মৃত্যুর দুঘণ্টা আগেও হাসি ঠাট্টা করেন । তারপরেই তো বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। সুব্রত মুখার্জী ছাত্র যুবদের প্রেরনা ছিলেন । ইন্দিয়া গান্ধী যখন হেরে গেছেন, তাঁর স্নেহের প্রার্থী ছিলেন , তখন দুর্দিনে তাঁর পাশে সুব্রত মুখ্যার্জী দায়িত্ব নিয়ে সামলেছেন। এই YMA ময়দানে বিরোধী নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মিটিং করিয়েছেন । আমি ছাত্র পরিষদের সভাপতি হবার পর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তখন সবে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন । এখানে ছাত্র পরিষদের সমাবেশ হয়েছিল। টুকরো টুকরো কথা মনে আছে। খুব খারাপ লাগছে । সুব্রতদা সব সময় প্রেরণা সাবলিল, সব কিছু সমস্যার সমাধান তাঁর কাছে ছিল। আমি যেদিন মন্ত্রিত্বে শপথ নিলাম , সেদিন সুব্রত মুখ্যার্জী আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তাই আজকে তাঁর সম্পর্কে বলতে বা লিখতে আমার ভীষনই কষ্ট হচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। তাঁর আত্মার প্রতি শান্তি কামনা করছি। তার পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা।
সব থেকে বেশি মনে পড়ছে যখন পার্টির দুর্দিন । সেই সময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে, যখন প্রিয়দা আমাদের দলে নেই প্রিয়দা অন্য দলে আছেন , সুব্রত দা গনিখান চৌধুরী আব্দুর সাত্তার সাহেবের সাথে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। বহরমপুর কংগ্রেস অফিসে প্রথম সভা হয় ৭৭ সালের হেরে যাওয়ার পর । সুব্রত মুখ্যার্জীর সেই ভাষন আজও আমার কানে বাজে । ‘আওয়াজ তোলেন যে আগামী দিনে ছাত্র পরিষদই কংগ্রেসকে প্রতিষ্ঠা করবে আবার’। ছাত্র আন্দোলন থেকে যাঁরা উঠে এসেছে তাঁরা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত। সুব্রত মুখার্জী বহু পরিশ্রম করেছেন কংগ্রেসের জন্য । মনে পড়ে , বলেছিলেন , জানিস তো রাইটার্স বিল্ডিয়ে ভুত আছে । রাত্রি বেলায় তারা বেডিং পত্রে নিয়ে ঢুকে পড়ে । সুব্রতাদার খুব ভুতের ভয় ছিল। আমি দেখেছি জরুরি অবস্থার সময় অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে থাকতে হত। তিনি তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন । উনি বলতেন , কেউ যেন এসে বলছে চা দেব স্যার , তারপর দেখি লোকটা নেই। এই ধরণের কথাবার্তা উনি বলতেন। সুব্রত মুখার্জী একজন রাজনীতির ঋষি। সমস্ত জিনিস টাকে তিনি মানিয়ে নিয়ে নিতে পারতেন এবং এমন ভাবে ফেস করতেন , বিধানসভায় দেখেছি , মন্ত্রি সভায় দেখেছি সুব্রত মুখার্জী সব সময় সাব্লিন এবং কালারফুল মানুষ ছিলেন। প্রমান করে দিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত হাসি ঠাট্টা মজা করে এবং সহজ সরল ভাবে । মানুষকে খুব কাছে টেনে নিতে পারতেন । যাকে স্নেহ ও ভালোবাসতেন সেখানে কোন খাদ থাকতো না এবং সেই সব মানুষ গুলোকে নিজের মনে করে নিয়ে চলতেন। সুব্রত মুখার্জীর মৃত্যুতে আমরা সত্যিকারের একজন অভিভাবককে হারালাম । তিনি যে দলেই থাকুন তাঁর রাজনৈতিক সৌজন্য বোধ এতো ভালো যে ভাবাই যায়না। তাঁর কাছে রাজনৈতিক সৌজন্য শেখার মতো । বিরোধী দল হলেও তিনি তার সঙ্গে রাজনৈতিক সৌজন্য র বেলাতে কখনই ভুলতেন না । তার জন্য প্রয়োজনীয় দরকারি কাজ সঙ্গে সঙ্গে করে দিতেন। সে বিরোধী হোক বা সরকারি হোক। তিনি সরকারি কাজে কখন দলমত দেখেন নি এবং যেটা ঠিক , সেটা করেছেন। খুব অল্প বয়সে পঞ্চায়েতে যে আইন সেটা সুব্রত মুখার্জীর তৈরি করা ,। তিনি পঞ্চায়েত মন্ত্রী ছিলেন তখন সেই আইন করছিলেন। আজকে যে আইনে পঞ্চায়েত পরিচালনা হচ্ছে , তার আইনের শ্রষ্ঠা কিন্ত সুব্রত মুখার্জী। খুব অল্প বয়সে মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন । মাত্র ২৪-২৫ বয়সে । ১৪ টা দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন । ক্যালকাটা কর্পোরেশনও পরিচালনা করেছেন। মন্ত্রীর সময় করেছেন , মেয়র হয়েও করেছেন । সুব্রত মুখার্জীর প্রশাসনিক যে ক্ষমতা, একদিকে প্রশাসক, একদিকে সহৃদয় ব্যক্তি , অন্যদিকে রাজনৈতিক সৌজন্য বোধ এই হচ্ছে সুব্রত মুখার্জী। আমাদের জীবনে দেখা সব থেকে কালারফুল লিডার বলতে যা বোঝায় । মানে কখনও কোন কিছুতে ঘাবড়ে যেতেন না । সব সময় মানিয়ে নিয়ে হেসে খেলে উড়িয়ে দিতেন । হেসে খেলে গোল করে দিতেন। একেবারে বার পোস্টে ঠিক জায়গাতে গোলটা করে দিতেন। সুব্রত মুখার্জী সম্বন্ধে বলতে গেলে শেষ হবে না । আজকে কলকাতার যা দেখছেন , সেই সময় কাজ করাতে তিনি জানতেন, কিভাবে কাজ করতে হয় । সব থেকে সাকসেসফুল কংগ্রেসের মেয়র ছিলেন সুব্রত মুখার্জী । আজকে আমাদেরকে একথা স্বীকার করতে হবে। সুব্রত মুখার্জী নেই এটা ভাবতে পারছি না । এখানে বসে আছি মনে হচ্ছে সুব্রত দা পাশেই বসে আছে । আমি কদিন আগেই বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়েছি। ফোনে কথা হয়েছে । সব সময় কেমন আছিস ভালো আছিস তো, ভালো করে কাজ কর ভালো থাক শরীর টা ভালো রাখ বলতেন। আমি তাঁর প্রতি এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলছি সুব্রতদা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।