স্নেহাংশু চট্টরাজ, মধ্যবঙ্গ নিউজ, বহরমপুরঃ সংখ্যালঘু মুসলিমরা কি মুখ ফেরাচ্ছেন ঘাসফুল থেকে? নেতাদের ভোটের অঙ্ক ছাড়াও এই প্রশ্ন নিয়ে উত্তেজিত আমআদমিও। চলতি মাসের দু’তারিখ আপাত নিরীহ সাগরদিঘির উপনির্বাচনের ফল বেড়নো ইস্তক এই প্রশ্নই চারিয়ে গিয়েছে ‘ভোট সর্বস্ব’ বাংলায়। সেই প্রশ্নে ইন্ধন জুগিয়েছে শনিবারের বারবেলায় মুর্শিদাবাদের ভিন্ন স্থানের সমগোত্রীয় দুটি সভা।
ক্ষমতায় এসে মমতা সরকার ইমাম ভাতা চালু করেছিল ২০১২ সালে। সেই অনুযায়ী একজন ইমাম পান মাসে ২,৫০০টাকা আর একজন মুয়াজ্জিন পান এক হাজার টাকা। আদালতের বারান্দা ঘুরে চালু হওয়া ওয়াকফ বোর্ড প্রদত্ত সেই ভাতা গত দশ বছরে এক পয়সা বাড়েনি। পুরোহিত ভাতা চালু হয়েছিল ২০২০ সালে। পুরোহিতরা পান হাজার টাকা প্রতি মাসে। অথচ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে দেশে।
লালবাগের পুরনো মতিঝিল পার্কে এই রাজ্যের প্রায় হাজার জন ইমাম মোয়াজ্জেম বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেই ভাতা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। ইমামদের সেই রাজ্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি তালিকাটাও ছিল লম্বা, সেখানে শাসকদলের নেতা বিধায়করাই মঞ্চ জুড়ে বসেছিলেন। তাঁদের সামনেই অন্য অনেক দাবির মাঝখানে রাজ্যের শাসক দলকে কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইমামরা। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, ওই মঞ্চে হাজির ছিলেন পুরোহিতরাও। তাঁরাও সমদাবি তুলেছেন। তাঁদেরও লক্ষ্য রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকার।
সারা বাংলা ইমাম-মোয়াজ্জিন অ্যাসোসিয়েশন অ্যাণ্ড চ্যারিটেবল ট্রাস্টের রাজ্য সম্পাদক নিজামুদ্দীন বিশ্বাস শনিবার দাবি করেন, “ ভাতা চালু হওয়ার পর তা আর বাড়ে নি। সংগঠনের পক্ষ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৫টি চিঠি দিয়েছি। সংখ্যালঘু দফতরে বারবার ধর্না দিয়েছি। কথা বলেছি। তারা কখনও ববি হাকিমকে দেখায় কখনও অন্য কাউকে দেখায়। কিন্তু কোথাও গিয়ে আমাদের দাবির সুরাহা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “ গরীব ইমাম মোয়াজ্জিনদের ঘর দেওয়ার কথা বলেছিল সরকার। তাও দেয় নি।” শুধু তাই নয় তিনি অভিযোগ করেন এই রাজ্যের একাংশ আমলা “টুপি-দাড়ি-ইসলাম” নিয়ে কটূক্তি করেন। তাঁদের সেই পদ থেকে সরানোর জন্যও সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। রাজ্যের সংখ্যালঘুদের সংখ্যার অনুপাতে কর্মসংস্থান, বাসস্থান দেওয়ার দাবি তুলেছেন নিজামুদ্দিনরা। তাঁরা আরও দাবি করেন, “জেলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ নবাব সিরাজদ্দৌলার নামে করতে হবে। জেলা ভাগ হলে মুর্শিদাবাদ নাম জেলার সঙ্গে জুড়ে থাকতে হবে।”
তৃতীয়বারের জন্য এই সরকারকে ক্ষমতায় আনতে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়েছিলেন বলেও এদিন দাবি করেন নিজামুদ্দীন। তিনি বলেন, “ নির্বাচনের সময় আমরা প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে দেখা করে ৩৫০টি সভা করেছিলাম। আমার নিজের জেলায় ৭৬টির উপর সভা করেছিলাম। আমার জেলার সব বিধায়ক সাংসদ সে কথা জানেন।” কিন্তু তাঁদেরকে গুরুত্বই দিচ্ছে না সরকার। তাঁদের দাবি না মানলে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগেই বৃহত্তর আন্দোলনে নামবেন ইমামরা। সে কথা জানিয়ে শনিবার কার্যত হুঁশিয়ারি দিয়ে নিজামুদ্দীন বলেন, “ আমরা প্রয়োজনে বিকল্প পথ ভাববো।” দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এদিন ইমামদের রাজ্য সম্পাদক বলেন, “ সাগরদিঘির মানুষকে সরকারের হয়ে বলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরা কেউ সে কথা শুনতে চান নি।”
বঙ্গীয় সনাতন ব্রাহ্মণ সংগঠনের সহ-সভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী ইমামদের পাশে দাঁড়িয়ে ওই মঞ্চ থেকে বলেন, “ আমাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত। তাই নিজামুদ্দীন সাহেবকে বলেছি আমরা আমাদের দাবি দাওয়া নিয়ে যৌথ মঞ্চ গড়ে রাজ্য জুড়ে ঝড় তুললে সরকার আমাদের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হবে।” তিনি এরপর হুঙ্কার দিয়ে বলেন, “ একটা গ্রামে এক হাজার ভোট থাকে। সেখানে যে জেতে পাঁচশো ভোটে জেতে। আপনি একজন ইমাম, আপনার সেই গ্রামে আপনার সঙ্গে আটশো লোক থাকে। না হলে আপনি মসজিদে আজান দিতে পারতেন না। একজন পুরোহিত দু’হাজার লোক নিয়ে চলে। আপনার পেছনে এত লোক থাকলে আপনার কথা কেন শুনবে না প্রশাসন? কেনই বা শুনবে না নেতারা। আমাদের দু’হাজার, এক হাজার টাকা ভিক্ষা দিয়ে কিছু হবে না। আমরা ইনকাম করে খাই। যদি সাম্মানিক দিতেই হয় তাহলে দশ হাজার টাকা ভাতা দিতে হবে। না হলে দিতে হবে না।” তিনি অভিযোগ করেন, “ আমাদের পঙ্গু করার জন্য এই নীতি নেওয়া হয়েছে।” সাংসদ আবু তাহের খান ইমামদের দাবিকে সঙ্গত বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “তাঁদের ভাতা বৃদ্ধির দাবি সঙ্গত।আমরা তাদের দাবি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেব।”
ওই দিন রবীন্দ্রসদনে তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের জেলা সম্মেলন ছিল। তৃণমূল সূত্রে দাবি, সাগরদিঘির ভোট বিপর্যয়ের পরে তড়িঘড়ি এই সম্মেলন ডাকা হয়েছিল, “সংখ্যালঘু মন বুঝতে।” কিন্তু ওই সংগঠনেরই সাধারণ সম্পাদক সফিকুল ইসলাম দাবি করলেন, “ ব্যক্তি স্বার্থে এই সম্মেলন করছেন সেলের সভাপতি। মূল সংগঠনের কোনও অনুমতি না নিয়েই এই সম্মেলন হয়েছে। আমার মত অনেকেই যায় নি।” কিন্তু সেলের সভাপতি নিজাম মন্ডল লম্বা তালিকা দেখিয়ে বলেন, “ জেলার ২৬টি ব্লক থেকেই সদস্যরা এসেছিলেন। বিধায়করাও এসেছিলেন।” মুর্শিদাবাদ বহরমপুর সংগঠনের চেয়ারম্যান তাহের বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত নন জানিয়ে এটাও বলেন, “ শাখা সংগঠনের উচিত নিজেদের কর্মসূচি মূল সংগঠনকে জানানো।” সাগরদিঘির উপনির্বাচন নিয়েও জেলার সংখ্যালঘু নেতাদের মধ্যেই পারস্পরিক দোষারোপের পালা অব্যহত। তবে ‘রাশ’ কি আলগা হচ্ছে শাসকের? প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে।