দেবনীল সরকারঃ গম থেকে তৈরি একটি প্রধান খাদ্য দ্রব্য হল রুটি। রুটি দিয়ে নিত্য রাতের খাবার খান বহু মানুষ। শহরের রাস্তায়, অলিতে গলিতে রয়েছে অনেক রুটির দোকান। এরকমই একটি দোকান চালান ৬৫ বছরের সুন্দরী সাও। আজ প্রায় ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে রুটি বানিয়ে চলেছেন বিহারের এই সাও পরিবার।
বহরমপুরের রাণীবাগান মোড়ে LIC অফিসের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে এই রুটির দোকান। সেখানে সপরিবারে রুটির ব্যবসা করেন সুন্দরী দেবী। তাঁকে সহযোগিতা করেন স্বামী সুবল সাও, ছেলে রবীন্দ্রনাথ সাও ও মেয়ে মঞ্জু সাহা। আটা মেখে চাকতি বেলনা দিয়ে নিজের হাতে রুটি বানান মঞ্জুদেবী। এই কাজে তাঁর জুরি মেলা ভার, বলেন ভাই রবি। তিনি বলেন, দিদির হাতের রুটির আলাদায় স্বাদ। যারা খেয়েছে তাঁরাই জানে। মা সুন্দরী দেবীর কাছ থেকেই রুটি বানানো শিখেছেন তিনি।
উনুনের গনগনে আঁচের সামনে বসে একটার পর একটা অনবরত রুটি সেঁকে চলেছেন সুন্দরী সাও। পাশে স্বামী ময়দা মাখছেন, ছেলে অর্ডার মাফিক রুটি প্যাকেট করছেন। রুটির সাথে এখানে পাওয়া যায় একটি নিরামিষ সবজির তরকারী। শহরের মানুষকে স্বাস্থ্যকর রাতের খাবার পরিবেশন ই সাও পরিবারের মূল উদ্দেশ্য। বিকেল ৫ টা থেকে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলে তাঁদের এই রুটির দোকান। রাত বাড়লে রুটি নিতে দোকানের সামনে রীতিমতো লাইন পরে যায়। প্রতিদিন ৫০০ অধিক রুটি বিক্রি করে থাকেন সাও পরিবার।
ষাটের দশকে বিহারের নালন্দা জেলার পাওয়াপুরী গ্রাম থেকে এখানে এসেছিলেন সুবলবাবু। এখানে এসে ছোট্ট একটি দোকান দিয়েছিলেন। সেখানে মুড়ি, চানাচুর, বিস্কুট এসব বিক্রি করতেন তিনি। দোকানটি আজও যথাস্থানেই আছে, আকারে তা আরও বড়ো হয়েছে। আর সংযোজিত হয়েছে দোকানের সামনের রুটি ব্যবসা। এই রুটির ব্যবসার সম্পূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী সুন্দরী সাও। সুন্দরী দেবী বহরমপুর শহরের একজন স্বয়ংসিদ্ধা মহিলা উদ্যোগপতি।
সংসার, পরিবার এসবের কথা ভেবে স্বামীর ব্যবসাকে আরও একটু বড় করার জন্যই সুন্দরী দেবীর এই ভাবনা। ৪৫ বছর ধরে তিলে তিলে গড়া সেই ভাবনা আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। বহরমপুরে তাঁদের রুটির সুনাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পরেছে। শহরে কোন বিশেষ অতিথি আসলে বা বড় ডাক্তার, উকিল ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের বাড়িতে নিত্যদিন রুটি যায় সুন্দরী দেবীর দোকান থেকে। রবীন্দ্রনাথ সাও বলেন, শোনা যায় একদা প্রয়াত প্রাক্তন রাস্ত্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বহরমপুরে এসে তাঁর মায়ের হাতে বানানো রুটি খেয়ে সুনাম করেছিলেন।
এই দোকান থেকে থেকে রোজ রুটি নেন গোরাবাজারের বাসিন্দা সুবীর পাল। তিনি বলেন, “ শহরে অনেক রুটির দোকান আছে, আমিও বিভিন্ন দোকান থেকে বিভিন্ন সময়ে রুটি কিনেছি। কিন্তু যবে থেকে মাসিমার দোকানের রুটি খেয়েছি, আর অন্য কোথাও যায় না। তারা পুরো পরিবার একসাথে বসে রুটি বিক্রি করে সেটা দেখতেও ভালো লাগে। মনে হয় বাড়ির তৈরি রুটি।” আজ প্রায় ৫ বছর ধরে রোজ এখান থেকে রুটি নেন তিনি।
১৯৯৫ সালে শহরের ইন্দ্রপ্রস্থ এলাকায় জমি কিনে নিজেদের বাড়ি করেছেন এই পরিবার। বছরে দু’বার বিহারের দেশের বাড়িতে যান তাঁরা। সেখানে রয়েছে তাঁদের বর্ধিত পরিবার। কিন্তু সাও পরিবার এখন বহরমপুরেরই বাসিন্দা। রবীন্দ্রনাথ বাবুর ছেলে পড়াশোনা করেন শহরের স্কুলে। মঞ্জুদেবীরও এই শহরেই বিয়ে হয়েছে। সব মিলিয়ে দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে লড়াই করে সুবল সাও, সুন্দরী সাও ও তাঁদের পরিবার আজ শহরের বুকে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের রুটির দোকান সপ্তাহে প্রতিদিন সন্ধ্যের পর ভিড়ে ঠাসা থাকে। অর্ডার দিতে হয় আগে থেকে।
বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসেছে রুটি বানানোর মেশিন। কিন্তু তা ব্যবহার না করে, সাবেকি ধারাতেই হাতে করে রুটি বানিয়ে, উনুনের আঁচে প্রস্তুত করেন রুটি। সুন্দরী দেবী বলেন, উনুনের রুটির স্বাদও ভালো এবং এই পদ্ধতিতে তৈরি রুটি স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী।