রৌদ্র ঝলমলে হরর : মিডসমার, নিঃসঙ্গতার ছবি Midsommar: Review

Published By: Madhyabanga News | Published On:

দেবনীল সরকারঃ জীবন একটা উপলক্ষ্য আর সিনেমা তা উদযাপন করতে চায় । সিনেমা, জীবন ও বাস্তবতার মাঝের উঁচু পাঁচিলকে অবলীলায় বেয়ে উঠে পড়ে, কখনো পাঁচিলের ওপরে বসানো পেরেকে হাত খাম করেও গল্পের সাথে ঢুকে পড়ে রূপকথার দেশে। ‘অ্যারি আস্তের’ এর ২০১৯ এর ছবি ‘মিডসমার’ আসলে একটি হরর- থ্রিলার- মিসট্রি ড্রামা। তবে এর ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে কিছু অদ্ভূত রিচুয়াল, যা সরাসরি ভাবে প্রকৃতির সাথে যুক্ত, যা ‘মৃত্যু’ একটি অনিবার্য প্রাকৃতিক ঘটনা –এই বানী প্রচারের মাধ্যমে এই গল্পে প্রবেশ করে এবং শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। আরও রয়েছে বর্তমান আমেরিকান সমাজ ও শিক্ষিত তরুন প্রজন্মের নিঃসঙ্গতার ছবি।

ছবি শুরু হয় ড্যানিকে দিয়ে, সে সাইকোলজির ছাত্রী। বাবা মা বোনের সংসারে ড্যানি একাই রোজগেরে সদস্য তাই তাকে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হয়, ঘুরে বেড়াতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বোন বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্তান্ত। শুরুতেই দেখি বোন ড্যানিকে ইমেইলে গুডবাই জানিয়ে সপরিবারে আত্মঘাতী হয়। ড্যানির এই নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র সঙ্গী বন্ধু ক্রিস্টিয়ান, সে নৃতত্ত্ববিদ্যার একজন গবেষক, তার বন্ধু পেল, মার্ক ও যশ। ক্রিস্টিয়ানদের আড্ডার জায়গা পেলের অ্যাপার্টমেন্ট।

Midsommar

সেখানে বসেই তাদের প্ল্যান হয় মিডসমার উপলক্ষ্যে সুইডেন যাবার। ‘হ্যারগা’, সুইডেনের একটি প্রাচীন, গ্রামীন উপজাতি। বন্ধু পেলও একজন হ্যারগা এবং ‘মিডসমার’ তাদের স্থানীয় আচার রীতি পালনের উৎসব। Summer অর্থাৎ গ্রীষ্মের মাঝামাঝি মনোরম আবহাওয়ায় নব্বই বছর অন্তর, নয়দিন যাবত এই উৎসব উদযাপিত হয় তাই এর নাম ‘মিডসমার’। পরিচালক আস্তের, হ্যারগা এবং তাদের এই উৎসবের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, “This is not a Swedish history, this is a folklore.”

ড্যানি, ক্রিস্টিয়ান, মার্ক ও যশ এসে পড়ে হ্যারগাদের মাঝে। এসেই সকলে প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যায়। শহুরে আমেরিকানদের, সুইডেনের সবুজে চোখ ধাঁদিয়ে যায়। সবাই খানিকবাদেই মত্ত হয়ে যায় নেশায়, এই নেশাও এই আচার অনুষ্ঠানেরই অংশ। সবাই প্রকৃতির কোলে নিজেদের উন্মুক্ত করে দেয়। ফিল্মের ভিজুয়ালকে অভিনেতা রেইনর বলেন এটা আসলে বিশেষ ধরণের ড্রাগ, ম্যাজিক মাশরুম ট্রিপের মতো। গ্রামের সকলেই খুব খুশি হয় ওদের সকলকে দেখে এবং তাড়াতাড়িই আপন করে নেয় সকলকে। গ্রামে ঢোকামাত্রই তাদের দেওয়া হয় চা-এর ন্যায় একজাতীয় পানীয় যা পান করার পরই তারা আরও একাত্ম হয়ে যায় প্রকৃতির সাথে। নয়দিনের এই ফিস্টের প্রথম পর্যায়েই তারা অদ্ভূত হ্যালুসিনেসনের মধ্যে প্রবেশ করে, যার মাথামুণ্ডু ড্যানি-ক্রিস্টিয়ানদেরও বুঝতে সমস্যা হয়, পারে না। ছবির এই নেশাতুর বিষয়গুলোকে স্ক্রিনে ট্রান্সলেসন প্রসঙ্গে এক ইন্টারভিউতে অ্যারি আস্তের বলেন, “We had some conversations with the other members of the cast, some of them, who hadn’t had mushroom trips before and talked about the experiences of it and how it feels…”

 

ড্যানি ও ক্রিস্টিয়ানের মধ্যে একটু মনমালিন্য হতেই গল্প রূপ নেয় এক ‘হরর ভবিতব্যের’। একে একে মার্ক ও যশ হরর ছবির কালের নিয়মে, অধিক উৎসাহ বশে মিলিয়ে যায় প্রকৃতিতে। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না, পরে যায়, মৃত অবস্থায়। মৃত্যু এই ছবিতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। আচার অনুষ্ঠান ও তার বীভৎসতার দিক থেকে মৃত্যু এখানে পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ অথচ প্রচণ্ড স্বাভাবিক রোল। হ্যারগাদের এই আচার আসলে প্রকৃতির উৎসর্গে, আর মৃত্যু যে অন্যান্য ঘটনার মতোই কি পরিমাণ প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ঘটনা –এই ছবির সার। ড্যানির একাকীত্ব তাকে মিলিয়ে দেয় হ্যারগাদের সাথে। সে একাত্ম হয়ে যায় এবং তাদের আচার অনুষ্ঠানে, ধীরে ধীরে হ্যারগাদের খেলা ধাপে ধাপে এগোতে থাকে, খেলার শেষে ড্যানি জয়ী হয়ে হ্যারগার মিডসমারের ‘মেরি কুইন’ নির্বাচিত হয়। ড্যানির একাকীত্ব যেন মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, ড্যানিকে হাসতে দেখা যায়। কিন্তু ক্রিস্টিয়ান হ্যারগাদের সাথে মিলে উঠতে পারে না। ‘মিডসমার ও হ্যারগা’ নিয়ে কৌতুহল ক্রিস্টিয়ানের জীবনে নিয়ে আসে এক অকল্পনীয় ক্ল্যাইমাক্স।

 

পরিচালক আস্তের, এই ছবির মেকিং প্রসঙ্গে বলেছেন, “It was a long process of trial and error to find the exact nuance of the visuals.”  এই ছবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্টগুলো হল সাউন্ড, কস্টিউম, আর্ট ও প্রোডাকশন ডিজাইন। ঘটনার ঘনঘটায় আমরা একে থ্রিলার- ড্রামা বলতেই পারি কিন্তু এই ছবি হরর হিসেবে অনন্যতার পরিচয় রাখে এর দৃশ্যায়নে। সাধারনভাবে হরর ছবির অস্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, রাত-অন্ধকার এ ছবি তার কোনটিকেই ব্যবহার করেনি। বরং হরর যে কিভাবে মনস্ত্বাতিক ভাবে, নেশাতুর অছিলায় প্রবেশ করে এই গল্পে, এবং রৌদ্রজ্জ্বল মনোরম ছুটির দিন পাল্টে যায় হরর প্লটে, তা এই ছবিতে প্রচণ্ড নতুন। তাই এই ছবিকে আমরা ‘রৌদ্র ঝলমলে হরর’ বলতে পারি। এরপর যেটা উল্লেখ করতে হয় তা হল এই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড। বুবি কৃল্কের তত্ত্বাবধানে ‘মিডসমার’ এর সাউন্ড তৈরি হয়, যা হিউম্যান সাউন্ডের সংকলন – চিৎকার, কান্না, হাসি, শ্বাস নেওয়ার শব্দ এবং হাঙ্গেরিয়ান বাদ্যযন্ত্রের সংস্পর্শে তা একটা আলো ঝলমলে দিনেও একটা ভয়েড তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই ছবির কস্টিউম আসলে খুব কাছ থেকে হ্যারগাদের কথা বলে ও তাদের রুচি সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়। হ্যারগাদের পোশাক মূলত সাদারঙের এবং পোশাকে ও শরীরে ফুলের ব্যাবহার করে।

ডিজাইনার Andrea Flesch এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “It’s a classic Swedish cut and design. But Ari had the decision that everybody’s in white and that these people are making their clothes for themselves. So, all the costumes had to be different by little details, it’s all handmade both in real life and in the story of the film. It’s as if they made it just for themselves.” ছবি জুড়ে ব্যবহার করা হয়েছে প্রচুর দৃশ্যকল্প। যা মিডসমারের রিচুয়াল অনুযায়ী সাজানো। ঘর বাড়ির দেওয়ালে আঁকা এই দৃশ্যকল্প ছবিকে ঘটনাগত দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। শেষে পৌঁছে আমরা দেখি ড্যানি ও ক্রিস্টিয়ান দুজন বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। ড্যানি হ্যারগাদের সাথে আত্মস্থ করে দেয় নিজেকে এবং ক্রিস্টিয়ান তার মিডসামারীয় কৌতূহলে হ্যারগাদের সাথে চলে যায় এক অন্য জোনে, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না।

‘মিডসমার’ ফিল্ম হিসেবে কেমন তা বিবেচনাযোগ্য, কিন্তু মিডসমার একটা এক্সপিরিয়েন্সকে তুলে ধরতে সক্ষম হয় এই ফিল্মের মধ্যে দিয়ে। প্রকৃতি, সম্পর্কের বিষাদ, জটিলতা এবং সর্বোপরি মৃত্যু –এই বিষয় গুলির সহাবস্থান ও এই গ্রামীণ রিচুয়াল ব্যবহার করে হরর প্লটে উপস্থাপন করার মাধ্যমে এই ফিল্ম নিয়ে পরিচালকের এক্সপেরিমেন্ট লক্ষ্য করা যায় যা ছবিটিকে বিশেষ উচ্চতা প্রদান করে।।