মজুরি বৃদ্ধির আশ্বাসে আশা ও হতাশায় দুলছে সাগরদিঘি

Published By: Madhyabanga News | Published On:

স্নেহাংশু চট্টরাজ, মধ্যবঙ্গ নিউজ, সাগরদিঘিঃ ফিনিক্স পাখির মত সাগরদিঘির বাজারে ফিরেছে বিড়ির গল্প। বাতাসে উপনির্বাচন। ভেসেছে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কথাও। এটা শুধু আশ্বাস না কি বাস্তবায়িত হবে কথা, সেই ধন্দে দুলছে আশা ও হতাশার দোলনা সন্তোষপুর, রতনপুর, মালিয়াডাঙা, মোস্তফাডাঙাপাড়া, ইমামনগর, কাবিলপুরের মত গ্রামীণ এলাকায়। সাগরদিঘিতে কোনও বড় বিড়ি কারখানা নেই। আছে অসংগঠিত শ্রমিক। ছিটেফোঁটা সংগঠিত শ্রমিক। এখানে মালিকপক্ষও সংগঠিত নয়। দু-চারজন উদোক্তা আছেন এই যা। যে সাগরদিঘির মঞ্চে দাঁড়িয়ে শাসকদলের শীর্ষ নেতা ঘোষণা করলেন হাজার বিড়ি বাঁধলে ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা মজুরি মিলবে, সেই সাগরদিঘির মানুষের একটা বড় অংশ চাষের উপর নির্ভরশীল। আছে পরিযায়ী শ্রমিক আর ক্ষেত মজুর।

মুর্শিদাবাদ জেলার বিড়ি মহল বলে পরিচিত ঔরঙ্গাবাদ, ধুলিয়ান আর জঙ্গিপুর। সেখানকার যে ঘরেই টোকা দেওয়া হোক না কেন সে ঘরেই অন্তত একজন বিড়ি শ্রমিকের দেখা মিলবেই। সাগরদিঘি এখনও বিড়ি কারখানার জন্য নাম করতে পারে নি কর্মক্ষেত্রে। তবু সেখানেই বিড়ি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা হল। ইতিমধ্যে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে। রাজনীতির আঁক কষাকষিতে তবু যদি সাগরদিঘির কিছু মানুষের রোজগার বাড়ে তাতেই বা অসুবিধা কোথায় পাল্টা জবাব শাসকদলেরও।

বিড়ির মহল্লায় ভোট এলেও বিড়ি বাঁধার বিরাম নেই

সন্তোষপুরের একটি ঝুপড়িতে গিয়ে দেখা গেল চালা ঘরের নিচে ফুটছে গরম ভাত। দুপুরের সেই রান্না ঘরে ব্যস্ত শাশুড়ি, বৌমা। বৌমা রিয়া বিবি একজন বিড়ি শ্রমিক। তাঁর স্বামী রমজান শেখ দিঘায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়েছেন। নির্বাচনের আগের দিন বাড়ি ফিরবেন। রিয়া বলেন, “ সপ্তাহে হাজার দুয়েক বিড়ি বাঁধি। তবে সব সপ্তাহে দু’হাজার বিড়ি বাঁধতে পারি না। হাজার বিড়ি বাঁধলে মুন্সি ১৬৫টাকা দেয়।” মাস গেলে কখনও সাতশো কখনও চোদ্দশো টাকা রোজগার হয় রিয়ার। রিয়া ও রমজানের দুই সন্তান। রিয়া বলেন, “বিড়ি বেধে যে টাকা রোজগার হয় তা দিয়ে ছেলের টিউশন পড়ার খরচ দিতে পারি।” রিয়ার শ্বশুরবাড়িতে চারজন লোক বিড়ি বাঁধেন। সকলেই নিজের নিজের ঘরোয়া খরচ করেন উপার্জনের টাকায়। রিয়ার শ্বাশুড়ি বলেন, “ আমার তিন ছেলে। তিনজনেরই কেউ সরকারের ঘর পায় নি।” রিয়ার পিসি শাশুড়ি মাসুদা বেওয়ার দাবি, “ ঘরের দরুণ এক লক্ষ বিশ হাজার টাকার বদলে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা দিয়েছে। জব কার্ডের কোনও টাকা পায় নি। বিডিওর অফিস, মেম্বারদের বলেছি শোনে নি কেউ।” কথোপকথনের সময় পাশ দিয়ে তখন হেঁটে যাচ্ছেন সাগরদিঘির কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস। ভোট ভিক্ষার পাশাপাশি গলায় উন্নয়নের হাজারও অঙ্গীকার কংগ্রেস কর্মীদের। রিয়াদের মত বাড়ির বউরা এই এলাকায় বিড়ি বেঁধে অতিরিক্ত উপার্জন করেন। আর তা দিয়ে সামাল দেন সংসার।

পাতার ওজন

যতদূর যাওয়া যায় পাশাপাশি গ্রামগুলিতে জঙ্গিপুর, ধুলিয়ান, ঔরঙ্গাবাদের বিড়ি কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত মুন্সিরা এই এলাকাতেও বিড়ির কাঁচামাল পাতা আর মশলা দিয়ে যান। সপ্তাহ শেষে এসে গুণে নিয়ে যান হাজার বিড়ি ১৬৫টাকার বিনিময়ে। রোজগার বাড়াতে অনেকই রাত দিন এক করে শ্রম দেন বিড়ি বাঁধতে। কোন কোম্পানীর বিড়ি কার বিড়ি, বিক্রয় মূল্য কত সেসবই অজানা থাকে বিড়ি শ্রমিকদের কাছে।
তবে স্থানীয়ভাবেও বিড়ি উৎপাদন হয় সাগরদিঘিতে। বেশ কয়েকজন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বিড়ি তৈরি করেন এলাকায়। তাঁদেরই একজন বেলাল খান। তাঁর  কোম্পানীর  বিড়ি সাগরদিঘির বাজারেই বিক্রি হয়। আশেপাশের এলাকাতেও যায় অল্পপরিমাণ। তবে প্রতিযোগিতা নেই কারও সঙ্গে, দাবি বেলালের।
বেলাল জঙ্গিপুর থেকে বিড়ির পাতা কিনে আনেন। জঙ্গিপুর সহ এ জেলার বিড়ি বেল্টে পাতা আসে উড়িষ্যা, তেলেঙ্গনা, মহারাষ্ট্র থেকে। জঙ্গিপুরের এক মহাজনের কাছ থেকে তেরো চোদ্দ হাজার টাকায় এক বস্তা (কমপক্ষে ৫০ কেজি) পাতা কিনে আনেন বেলাল, নিজের পুঁজি মত। বেলাল দুশো টাকা কেজি দরে এক কুইন্ট্যাল বিড়ির মশলা বা তামাক কিনে আনেন সেই জঙ্গিপুর থেকে। বেলাল বলেন, “আশি টাকা কেজিতেও মশলা পাওয়া যায়। আমি যে মশলা ব্যবহার করি সেটায় কাঠি থাকে, যা বিড়িকে অনেকক্ষণ জ্বলতে সাহায্য করে। এই কাঠি না থাকলে টানতেও কষ্ট হয়। স্বাদ থাকে না। অনেকেই পাঁচ রকম তামাক মিশিয়ে নেন নিজেরা আমি এই মিশ্রণ কিনে আনি।”

এক বস্তা পাতায় এক লক্ষ বিড়ি তৈরি করা যায়। তার জন্য ৩০ কেজি মশলা লাগে। এই কাঁচা মাল বেলাল তার এলাকার নির্দিষ্ট কয়েকজন মহিলাকে দিয়ে আসেন। বেলাল বলেন, “ যাঁদের চাহিদা আছে তারা দু’দিনে হাজার বিড়ি তৈরি করে দিয়ে যান। কেউ কেউ দেরি করেন।” সেই বিড়ি বেলাল নিজেই প্যাকেট করেন বাড়িতে। এক প্যাকেটে ২০টি বিড়ি থাকে। সেই বিড়ি স্থানীয় দোকানে দিয়ে আসেন নিজেই। আলাদা কোনও লোক নেই। কুড়ি প্যাকেট বিড়ি তিনি বিক্রি করেন ১৫০ টাকায়। বাজারে সেই বিড়ি বিক্রি হয় দশ টাকা প্রতি প্যাকেট। বেলাল বলেন “ এই ব্যবসা করে বাবা আমাকে মানুষ করেছেন। পড়াশোনা শিখিয়েছেন। বাড়ি করেছেন। কোম্পানিতে চাকরি করলে এর থেকে বেশি আয় হত না।” তিনি মনে করেন, আয় আরও বেশি হত যদি প্রতিদিন লাখ খানেক বিড়ি বিক্রি করতেন। সেটা সম্ভব নয় পুঁজির অভাবেই। তিনি বলেন, “ বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি বাড়লে আমার আয় কমে যাবে। আমি তো আর বেশি দামে বিক্রি করতে পারব না।”
মুর্শিদাবাদ জেলা বিড়ি মজদুর অ্যাণ্ড প্যাকার্স ইউনিয়নের জেলা সভাপতি  জ্যোতিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ সাগরদিঘির কাবিলপুর, বালিয়া, মণিগ্রামে সংগঠিত শ্রমিক আছে ১৮-১৯ হাজার। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে অসংগঠিত শ্রমিক আছে আরও বিশ-তিরিশ হাজার। সাগরদিঘির মঞ্চে যে ঘোষণা হল তার ফলে মালিকের লাভ কমবে। শ্রমিক কমবে। উৎপাদন কমবে। ফলে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভব তা যুবরাজ নিজেও জানেন।”