ভোট এলেই মনে পড়ে মুসলমানের কথা ?

Published By: Madhyabanga News | Published On:

সেখ ইনসাফঃ ভোট শুরু হয়ে গিয়েছে রাজ্যে। আর প্রতিবারের মতো এই বছরও ভোটে সংখ্যালঘুদের জন্য প্রতিশ্রুতির ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। রাজনীতিবিদারা যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুদের একটি ‘ ইউনিফায়েড ভোট ব্যাঙ্ক’ মনে করেন। চলছে মুসলিম সমাজের সমস্ত মানুষের মুশকিল আসান করার প্রতিশ্রুতির বন্যা।

কিছু কেউ খোঁজ নিয়ে দেখছেন, কেমন আছে রাজ্যের মুসলমানরা ?

‘সাচার কমিটি ’ শব্দবন্ধের সাথ আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় সাচার কমিটির রিপোর্ট।

সাচার কমিশনের রিপোর্ট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল রাজ্যে সংখ্যালঘুদের করুণ দশা।

কী ছিল সে রিপোর্টে ?

সাচার রিপোর্ট আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল , এই রাজ্যে  সরকারি দপ্তরে  উচ্চপদে মুসলমানদের অংশগ্রহণ মাত্র ৪.৭ শতাংশ, এবং মোট সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ  মাত্র ২.১ শতাংশ।

সাংবাদিক দেবাশিস আইচের একটি নিবন্ধে তিনি সাচার কমিটির রিপোর্ট থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তা তুলে ধরলে জানা যায়,

মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান : পশ্চিমবঙ্গ

মাথাপিছু মাসিক ভোগ (টাকায়) : হিন্দু — ৬১০। মুসলমান — ৫০১ (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৬৩৫)।  তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৫৩৪।

গ্রামে দারিদ্রের হার (শতাংশ) : হিন্দু — ২৪%। মুসলমান — ৩৬% (সর্বভারতীয় গড়ঃ ২৬.৯%)। তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৩১%।

শহরে দারিদ্রের হার (শতাংশ) : হিন্দু — ২১%। মুসলমান — ৪৪% (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৩৮.৪%)। তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৪১%।

সাক্ষরতা : হিন্দু : ৭২.৪%। মুসলমান : ৫৭.৬% (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৫৯.১%)। তফসিলি জাতি-জনজাতি — ৫৬.১%।

শিশু মৃত্যুর হার : হিন্দু — ৬৮। মুসলমান — ৭৭ (সর্বভারতীয় গড়ঃ ৮৩)।

এই নিবন্ধেই দেবাশিস আইচ লিখছেন,

“এ রাজ্যে মুসলমানদের ৮৩ শতাংশ গ্রামে বাস করেন। ২০০৬ সালে রাষ্ট্র্বের পরিষেবা তাদের কাছে ঠিক কতটা পৌঁছেছিল তা জানতে আমাদের সাচার কমিটির রিপোর্টে চোখ বোলাতে হবে। প্রাইমারি স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডাকঘর, বাস স্টপ, পাকা রাস্তা এই পাঁচটি প্রাথমিক সরকারি সুযোগসুবিধার পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, হিন্দু প্রধান গ্রামগুলির তুলনায় মুসলমান প্রধান গ্রামগুলি পিছিয়ে রয়েছে। রাজ্যে বিভিন্ন পরিষেবা আছে, এমন গ্রামের অনুপাত (অংশ) নীচে দেওয়া হল।

প্রাইমারি স্কুল : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৯৮.৫। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৯৭.৮।

স্বাস্থ্যকেন্দ্র : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৮১.২। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৭৩.১।

ডাকঘর : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৭৬.৪। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৫৯.৭।

বাস স্টপ আছে : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৫১.৮। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৪১.৮।

পাকা রাস্তা : বড় হিন্দু প্রধান গ্রাম — ৭১.৬। বড় মুসলমান প্রধান গ্রাম — ৬৪.৪”।

এই তথ্য আমাদের কাছে পরিষ্কার করে দেয়, সরকারের অবহেলাই সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার কারণ।

তবে ২০১১ সালে রাজ্যে পটপরিবর্তনের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের বড়ো অংশ। সংখ্যালঘু উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, চোখের জল মোছানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজ্যে এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের জোট সরকার।

সেই সরকারও কথা রাখেনি। সংখ্যালঘু উন্নয়নে বিশেষ কোন কাজ হয় নি। বরং ইমাম ভাতা দিয়ে রাজ্যে একরকম ভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ইন্ধ জোগানো হয়েছে। এতে সমস্যায় পড়েছেন সংখ্যালঘু সমাজের মানুষই।

তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের দুরবস্থার কথা ধরা পড়ে “লিভিং রিয়েলিটি অভ মুসলিমস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল” শীর্ষক রিপোর্ট থেকেই। ২০১৪  সালে এই রিপোর্ট প্রস্তুত করে  এসোসিয়েশন স্ন্যাপ এন্ড গাইডেন্স গিল্ড, এবং প্রতীচী ইনস্টিটিউট। ২০১৬ সালে সম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।

এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সমীক্ষা চালানো হয়েছিল এমন মুসলিম পরিবারগুলির মধ্যে ৩৮ শতাংশের রোজগার মাসে আড়াই হাজার টাকা। সমীক্ষা থেকে জানা যায়,  সমীক্ষার অন্তর্গত ১.৫৫ শতাংশ গ্রামীন পরিবারের মূল উপার্জনকারী স্কুল শিক্ষকের চাকরি করেন। গ্রামীণ মুসলমানদের ১০.১১ শতাংশ খেতমজুর আর ৪৭.০৪ শতাংশ দিনমজুর। চাষি ১৫.৪২ শতাংশ। সরকারি চাকরি করেন মাত্র  ১.৫৪ শতাংশ। বেসরকারি সংস্থায় ১ শতাংশ কর্মরত । সংখ্যালঘু নিবিড় এলাকায়  রাস্তা-বিদুৎ-পানীয় জল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো সরকারি পরিষেবাও ঠিকমতো পৌঁছায় না।

অন্যদিকে দেশজুড়ে সংখ্যালঘু মানুষের উপর বেড়ে চলা আক্রমণ, এনআরসি-সিএএ নিয়ে ছড়ানো প্রচার এক তীব্র অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

কোন সরকারেরই সদিচ্ছা নেই সংখ্যালঘু উন্নয়নে।

অন্যদিকে এমআইএম, আইএসএফের মতো রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘু অধিকারের কথা বলে ধর্ম আর রাজনীতিকে এক করে দিচ্ছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এই পরিণতি সুখকর হয় না।

রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষের বৃহৎ অংশ এই দলগুলির উপর ভরসা রাখছে এমনটাও নয়।

তবে একুশের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে রাজ্যে বিজেপিকে রোখার দায়িত্ব সংখ্যালঘুদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন, তাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে।

‘হিন্দু-মুসলমান’ রাজনিতি সামনে আছে। পিছনে চলে যাচ্ছেন সংখ্যালঘু উন্নয়নের প্রশ্নটি। যে প্রশ্নে সমস্তা ধর্ম, শ্রেণির মানুষেরই খোলাখুলি আলোচনা করার কথা।

কিন্তু ভোটের দড়ি টানাটানিত ব্যস্ত দলগুলির হাতে সেই সময় নেই বলেই মনে হয়।

তাই, সেই তিমিরেই সংখ্যালঘুর আর্থসামাজিক অবস্থা।

ঋণঃ ১) সাচার কমিটি রিপোর্টের দশ বছর পরেঃ সাবির আহমেদ

২) বাংলার মুসলমান সমাজ : ঐতিহাসিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকারঃ দেবাশিস আইচ

ছবিঃ মেহেদি হাসান

( মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)