স্নেহাংশু চট্টরাজ, মধ্যবঙ্গ নিউজঃ উপনির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, বসন্তে ততই ঘামছে সাগরদিঘি। এই নির্বাচন জেলা স্তরের ক্রিকেট ম্যাচ হলেও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে এই বিধানসভা উপনির্বাচনকে রাজ্য স্তরের ম্যাচ হিসেবেই দেখতে চাইছেন নেতারা। তাই এই বিধানসভায় জয় ছিনিয়ে নিতে উপনির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছে সব দলই। তবে সাগরদিঘির উন্নয়নের দিশা কী হবে তা নিয়ে এখনও তেমন কোনও কথা শোনা যায় নি নেতাদের মুখে। বদলায়নি বিড়ি শ্রমিকদের নিত্য দিন। শুকিয়েছে আপেল বাগান। জমি জটে ধুমড় পাহাড়ের তিনশো গাছের আম বাগান। অগোছালো ছামুগ্রামের আম বাগান। সাগরদিঘির জল শুকোচ্ছে ব্যাক্তিগত মালিকানার দ্বন্দ্বে।
একুশের বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদের এই ৬০ নম্বর বিধানসভা আসনে ৫০.৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিধায়ক হয়েছিলেন তৃণমূলের সদ্য প্রয়াত নেতা সুব্রত সাহা। ওই একইভোটে সুব্রত’র প্রাপ্ত ভোটের প্রায় অর্ধেক ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন বিজেপি’র মাফুজা খাতুন। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৪.০৮ শতাংশ। ১৯.৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তালিকায় তিন নম্বরে ছিলেন কংগ্রেসের হাসানুজ্জামান(বাপ্পা)।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই ব্লকের জনসংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ১০ হাজার ৪৬১ জন। তার মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিলেন ২ লক্ষ ৭৯৬ জন। মুসলিম সম্প্রদায় ছিলেন ৬৪.৬৮ শতাংশ। হিন্দু সম্প্রদায় ৩১.৫৬ শতাংশ। অন্যান্য সম্প্রদায় ৩.৭৬ শতাংশ। সরকারি নিয়মে পরবর্তী জনগণনা না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী দশ-এগারো বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধরে নেওয়া হয় ৭.৫% শতাংশ। সেই হিসেব ধরলে সাগরদিঘির বর্তমান জনসংখ্যা আনুমানিক ৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ৭৪৬ জন। সংখ্যালঘু বাসিন্দা আনুমানিক ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৮৫৬ জন। মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা হবে সেই হিসেবে ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৬১৬ জন।
২০২৩ এর এই অকাল নির্বাচনে সাগরদিঘি বিধানসভায় মোট ভোটারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৮২৫ জন। তার মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লক্ষ ২৪ হাজার ৫২৩ জন। মহিলা ভোটার এক লক্ষ ২১ হাজার ২৮৭ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ৫ জন।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী “একুশের নির্বাচনে প্রবল বিজেপি হাওয়ায় মেরুকরণের রাজনীতির ফয়দা তুলেছিল তৃণমূল।” সেই সূত্রে, রাজ্যে এখন গেরুয়া ঝড় ঝিমিয়ে পড়েছে। জেলাতেও সংগঠন বছর দুয়েক আগের তুলনায় দুর্বল হয়েছে। কংগ্রেস ও সিপিএমের সংগঠন দুর্বল হলেও এই উপনির্বাচনেও দুই দল হাত মেলানোয় কিছুটা শক্তি পেয়েছে। তবে তা জয়ের জন্য যথেষ্ট কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে দুই দলের নেতাদেরই মনে। সেই হিসেবে এই আসন ফের তৃণমূলের পক্ষে যাবে বলেই রাজনীতির কারবারিদের গরিষ্ঠ অংশেরই মত। জঙ্গীপুরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি খলিলুর রহমান বলছেন, “আগের তুলনায় অন্তত একটি ভোটও বেশি পেয়ে জিতব আমরাই।”
তবু ‘সাবধানের মার নেই’ বলে প্রায় বারো বছর পর স্থানীয়দের দাবি মেনে ভূমিপুত্র দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই বিধানসভার উপ নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে সংসারের নিত্য ঝামেলায় ছেদ টেনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খলিলুর অবশ্য কোন্দলকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বলছেন, “ আমরা জিতব উন্নয়নকে হাতিয়ার করে। মমতা দিদিকে সামনে রেখে।” আগের নির্বাচনের প্রার্থী মাফুজাকে বদলে এবার বহরমপুরের দিলীপ সাহাকে এই নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে নিজেদের ফলাফল পাল্টে দিতে চেষ্টা করেছে বিজেপি। বিজেপি’র প্রার্থী দিলীপ বলছেন, “আমরাই সাগরদিঘিতে পরিবর্তন এনে সাগরদিঘির উন্নতি করে রাজ্যকে দেখিয়ে দিতে পারব।” শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, “তোলামূলের দুর্নীতি থেকে পরিত্রাণ পেতে সাগরদিঘিতে বিকল্প ভারতীয় জনতা পার্টি। কংগ্রেস ও সিপিএম(আই) টেস্টেড ও রিজেক্টেড”। তবে বাপ্পাকে সরিয়ে বিড়ি মালিক বাইরন বিশ্বাসকে ধুলিয়ান থেকে সাগরদিঘিতে এনে এই বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়কে চমক দিতে চেয়েছেন একমাত্র বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী। জয় ছিনিয়ে আনতে মরিয়া প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছুটছেন অঞ্চলে অঞ্চলে। মানুষ তাঁদেরই চাইছেন বলে দাবি করছেন তিনিও।
বিজেপি’র শুভেন্দু অধিকারী ঘুরে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার সাগরদিঘি এসেছেন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় প্রার্থীর প্রচারে ঘুরে গিয়েছেন ইতিমধ্যে। রবিবার আসছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এলাকায় এলাকায় টহল দিচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। ঘুরছে তিন পযর্বেক্ষকের গাড়ি। আপাত নিরীহ উপনির্বাচন ঘিরে উত্তেজনার পারদ চড়ছে তীব্র গতিতে। কংগ্রেস প্রার্থীর হোর্ডিং আর ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছে সাগরদিঘি। দলীয় প্রার্থীর প্রচারে ঘাটতি নেই বিজেপি কিংবা তৃণমূলেরও। তবে কার পক্ষে যাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত, দেওয়াল লিখনই ললাট লিখন কি না তার জন্য অপেক্ষা এখনও এক পক্ষকাল।