সম্প্রতি বঙ্গীয় বিজেপির কয়েকজন সাংসদ ও বিধায়ক পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক হয়ে রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়েছেন। পৃথক রাজ্যের দাবি নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর ব্যাপার।তবে আশার কথা এই যে, দাবিটি খুব একটা সংগঠিত নয়, বরং বিক্ষিপ্ত।সাধারণ সভা অথবা সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিগত মত হিসেবে পৃথক রাজ্য গঠনের কথা বলা হয়েছে।বিজেপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলীয় সাংসদ-বিধায়কদের রাজ্য ভাগের প্রস্তাবকে সমর্থন করা হয়নি।তবে ঘর পোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার মতো বাংলা ভাগের কথা শুনে একজন বাঙালি হিসেবে মনে শঙ্কা জাগছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, উপমহাদেশের মধ্যে বাংলায় প্রথম ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে ‘ভারতের দিবাকর’ ডুবেছিল বাংলায় পলাশীর প্রান্তরে। ব্রিটিশদের উপমহাদেশ শাসনের কেন্দ্র বা রাজধানীও ছিল বাংলা।সে সময় বাংলা ছিল উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ প্রদেশ।আবার এই বাংলার মাটিতেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাধিক প্রতিবাদ আন্দোলন সংঘঠিত হয়েছে। ১৭৭০ সালে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ- একটার পর একটা সশস্ত্র আন্দোলন ব্রিটিশ শাসকদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।বাংলার মানুষ বরাবর নিজেদেরকে একটি জাতি হিসেবে চিন্তা করতে ভালোবেসেছে এবং বিদেশি ব্রিটিশ শাসকদের বিতাড়িত করতে চেয়েছে।কাজেই বাংলা নিয়ে ব্রিটিশদের বিরক্তি বিড়ম্বনার অন্ত ছিল না।এহেন ‘বিদ্রোহী’ বাংলাকে বাগে আনতে ব্রিটিশ প্রশাসকদের নানান নীতি-কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে যার অন্যতম হল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’।শান্তিতে শাসন করার স্বার্থে যেমন বাংলার ভূখণ্ড ভাগ করা হয়েছে তেমন হিন্দু ও মুসলমান, বাংলার এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
নবাবি আমল থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা ছিল একই প্রাদেশিক প্রশাসনের অধীন। ১৯০৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের নির্দেশে বাংলাকে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে বিভক্ত করা হয়।পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে একটি হিন্দুপ্রধান প্রদেশ এবং পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি মুসলমানপ্রধান প্রদেশ গঠন করা হয়।প্রদেশ পুনগঠনের প্রশাসনিক প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার না করেও বলা যায় বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।ভৌগোলিক বিভাজন ঘটিয়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দূরত্ব রচনা করে বাঙালির ঐক্যের ওপর আঘাত হানাই ছিল ব্রিটিশ প্রশাসকদের মূল লক্ষ্য।বলা বাহুল্য, এ কাজে তারা সফলও হয়।বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে বাংলার হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি সংহত হতে শুরু করে।বঙ্গভঙ্গের বছর খানেক পরে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় গঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। এক দশকের মধ্যেই ১৯১৫ সালে হরিদ্বারে গড়ে ওঠে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা। নামকরণেই দল দুটির সাম্প্রদায়িক চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৮৮৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশের পরে মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার মতো সম্প্রদায়ভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন বাংলা তথা ভারতের জন্য ভালো হয়নি।যাইহোক, হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গের ভালমন্দ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করলেও বাংলার সাধারণ মানুষ তাদের মাতৃভূমির বিভাজন মেনে নিতে পারেনি।সব দিক থেকেই বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করা হয়।
কংগ্রেস জোরদার আন্দোলন করে। অনুশীলনী সমিতির সশস্ত্র সংগ্ৰাম বৃদ্ধি পায়।বাংলার সাহিত্যকর্মীরা সোচ্চার হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমানের একতার প্রতীক হিসেবে রাখী বন্ধন উৎসবের সূচনা করেন।রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর আহ্বানে ১৬ অক্টোবর’১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন বাংলার বাড়িতে বাড়িতে অরন্ধন দিবস পালিত হয়।ওই দিন বাংলার মানুষ উপোষ করে।বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী জনজাগরণের ফলশ্রুতিতে স্বদেশী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়।ব্রিটিশ সরকার সার্বিক বিরোধিতার মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯১১-এর ১২ ডিসেম্বরে বঙ্গভঙ্গ রদ করে কিন্তু বাংলার ওপর প্রতিশোধ নিতে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লী স্থানান্তর করা হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সময় পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত যত সহজে গ্ৰহণ করা হয় বাংলা বিভাজন কিন্তু তত সহজে হয়নি।বাংলাকে অখণ্ড রাখার একটা ঐকান্তিক চেষ্টা চালানো হয়েছিল।ভারত অথবা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে সার্বভৌম বাংলা গঠনের স্বপ্নও দেখা হয়েছিল।শরৎচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের একাংশ এবং আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের একাংশ এই উদ্যোগে সামিল হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্ৰহণ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা।এই সময় তারা ভারত ভাগ না হলেও বঙ্গভঙ্গ করতেই হবে বলে আওয়াজ তোলে।গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল প্রমুখ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব ভারত ভাগের মতো শেষ পর্যন্ত বাংলার বিভাজনকেও তৎকালীন পরিস্থিতির স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে মেনে নেন।
১৯৫৬ সালে ভারতে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনগঠন করা হয়।পশ্চিমবঙ্গের হিন্দিভাষী অঞ্চল মানভূম বিহারে যায় আর বিহারের বাংলাভাষী এলাকা পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গে আসে।তখন থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে কোনও পরিবর্তন হয়নি।তবে মাঝেমধ্যে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন হতে দেখা গেছে। ১৯৮০ সালে ইন্দ্র বাহাদুর রাইয়ের নেতৃত্বে দার্জিলিংয়ে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। ১৯৮৬ সালে সুভাষ ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গোখা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জি এন এল এফ) পৃথক গোখাল্যাণ্ডের দাবিতে দার্জিলিংকে অশান্ত করে তোলে।পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘৮৮ সালে দার্জিলিং গোখা হিল কাউন্সিল গঠন করে স্বায়ত্বশাসন মূলক একটা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ২০০৭ সালে বিমল গুরুং সুভাষ সিঘিংয়ের সঙ্গত্যাগ করে নতুন দল গোখা জনমুক্তি মোচা গঠন করেন এবং গোখাল্যাণ্ডের দাবিতে পুনরায় সোচ্চার হন। পাহাড়ের অবস্থা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি গোখাল্যাণ্ডের দাবিকে সমর্থন জানায় এবং বিমল গুরুংয়ের দলের সাহায্য নিয়ে পদ্মফুলের প্রার্থী যশবন্ত সিং জয়লাভ করেন।২০১১ সালের জুলাই মাসে গোখাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গঠন করা হয়। ‘১৩ সালের জুলাই-এ বিমল গুরুং জি টি এ থেকে পদত্যাগ করেন।এখনও নরমে-গরমে গোখাল্যাণ্ডের দাবি চলতেই আছে।
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো নিয়ে পৃথক কামতাপুর রাজ্যের দাবিতে কামতাপুর পিপলস্ পার্টির নেতৃত্বে ১৯৯৬ সাল থেকে আন্দোলন চলছে।তৈরি হয়েছে জঙ্গি সংগঠন কামতাপুর লিবারেশন অগানাইজেশন। ২০০৮ সালে পৃথক রাজ্যের দাবিকে কেন্দ্র করে কোচবিহার রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে।একাধিক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কামতাপুরী তথা রাজবংশী ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়।রাজবংশী অবশ্য কোনও স্বতন্ত্র ভাষা নয়।বাংলারই উপভাষা।মুল বাংলা বলতে-বুঝতে-লিখতে-পড়তে উত্তরবঙ্গের অধিবাসীদের কোনও সমস্যা হয় না কারণ বাংলাই তাদের মাতৃভাষা।উপভাষার স্থান কখনও প্রধান ভাষার উপরে হওয়া উচিত নয়।কিন্তু কামতাপুরের দাবিদারদের কাছে বাংলার বিনিময়ে রাজবংশী ভাষার প্রসার কাম্য হয়ে উঠছে যা বাংলা ভাষা ও বাঙালির অখণ্ড জাতিসত্ত্বার স্বার্থ বিরোধী।এখন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বারলা উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলছেন।এর ফলে রাজ্যে নতুন করে অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা জাগছে।
২০০০ সালে আদিবাসী কুর্মিনেতা অজিত মাহাত জঙ্গল মহলে গ্ৰেটার ঝাড়খণ্ড আন্দোলন শুরু করেন।পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্ৰাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের সঙ্গে ওড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ডের কিছু এলাকা নিয়ে একটা নতুন রাজ্য গঠনের কথা বলা হয়।এই আন্দোলন অবশ্য খুব একটা জনসমর্থন লাভ করতে পারেনি।এখন বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গল মহলকে পৃথক রাজ্য করার দাবি করছেন।অথচ জঙ্গল মহলের মানুষের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার কোনও বিরোধ নেই।একটি নির্দিষ্ট এলাকার তথাকথিত অনুন্নয়নজনিত অসন্তোষ পৃথক রাজ্য গঠনের দাবির উপযুক্ত কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
কোনও ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষার প্রশ্নে মূল প্রবাহের রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব অনেক।শাসকদল অথবা বিরোধী দলের নেতানেত্রী ও উচ্চ স্তরের জনপ্রতিনিধিদের এমন কিছু করা অথবা বলা উচিত নয় যাতে কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বা সংগঠন উৎসাহিত হয়।কিছু আসনে হারা-জেতা, কেন্দ্রে অথবা রাজ্যে সরকার গড়া-না গড়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখা।
( মজিবুর রহমান সাগরদীঘির কাবিলপুর হাইস্কুল প্রধানশিক্ষক)
(লেখায় প্রকাশিত মতামত প্রাবন্ধিকের নিজস্ব)