পদ্ম পাতায় মাছভাত, বাংলাদেশের স্বাদঃ আদি ঢাকা হিন্দু হোটেল

Published By: Madhyabanga News | Published On:

বেদান্ত চট্টোপাধ্যায়ঃ  বহরমপুর শহরে  আজও অনেক হোটেলে পাওয়া যায় পদ্ম পাতার উপরের গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। তবে এর মাঝে  আছে একটি বিশেষ ‘হোটেল ’। এই হোটেলে পদ্ম পাতায় গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে পাওয়া যায় ওপার বাংলা অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশের বিভিন্ন রান্নার পদ। ভাবছেন কোন হোটেলের কথা বলছি ! অনেকে হয়তো বুঝতেও পেরেছেন, তবে হোটেলের নামটা জানার আগে আমাদের পৌঁছে যেতে হবে আট দশক আগে।

গল্পটা শুরু হয়েছিল আজথেকে ৮০ -৮৫ বছর আগে । অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরের হরেন্দ্র নাথ সাহা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন  মুর্শিদাবাদ ঘুরতে আসেন।  তারপরই শহর কে ভালোবেসে, শহরের মানুষ কে ভালোবেসে থেকে যান বহরমপুর শহরে । তখনও দেশ পরাধীন, বহু লড়াইয়ের পরে স্বাধীনতা দেখে দেশ ।  দেশভাগ থেকে স্বাধীন দেশের বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী এই “আদি ঢাকা হিন্দু হোটেল”। হরেন্দ্র বাবু আজ নেই হোটেল সামলান তার পুত্র বকুল সাহা।

বহরমপুরে এলে অনেকেরই দুপুরের খাবার ভারসা এই হোটেল । আদি ঢাকা হিন্দু হোটেল, বহরমপুর ।

বহরমপুরের চাকচিক্য পূর্ণ হোটেলের সাথে বেশ পাল্লা দিয়ে চলেছে  এই হোটেল। এই “আদি ঢাকা  হিন্দু হোটেল” সম্ভবত বহরমপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত ভাতের  হোটেল। আজও পদ্ম পাতায় গরম ভাত, আলুভাজা, বিউলির ডাল,ওপার বাংলার বিভিন্ন রকমের তরকারি, বিভিন্ন রকমের  মাছ, খাসির মাংস, মুরগির মাংস থাকে প্রতিদিনের মেনুতে। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন প্রায় ২০- ২২ রকমের মাছই রোজ রান্না হয়। বাজারের অবস্থা কখনো  একটু খারাপ হলেও মিনিমাম ১২- ১৪ রকমের মাছের আইটেম হয়েই থাকে । আর সবটাই বাংলাদেশের রান্নার রেসিপিতে । রাঁধা হয়  ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, লটে মাছের ঝুরো , চিতল কালিয়াও  । যাঁরা ওপার বাংলা থেকে দেশ ভাগের সময় এদেশে এসেছিলেন তাঁদের মুখে মাঝে মাঝেই শোনা যায় “আমাগো মতো রান্না এ দ্যাশের লোক পারবো না, আমরা যা মাছ খাই, অনেকে তা শোনেই নাই! ”

ওপার বাংলার রেসিপি মেনেই হয় প্রতিদিনের রান্না

এ শুধু গল্প নয় সত্যি সত্যি এমন বহু রান্নাই এখানে হয় ।  যেমন প্রতিদিনের মাছের তালিকায় থাকে রুই মাছের পাতলা ঝোল , কাটাপোনা, গোটপোনা, সর্ষে ইলিশ, সরপুটি, চিতল কালিয়া , রুই পোস্ত , চিংড়ি, শোল, আর মাছ , সর্ষে তেলাপিয়া, রুই ভাপা, পাবদা,পমফ্রেট, কাজরী, পুটি, বাটা, খয়রা, ফাঁসা, জিওল, কই। গল্প কথা না এ সত্যি ।  যেমন নাম তেমনি হোটেলের বিভিন্ন পদ । এই শহরের এক পুরোনো বাসিন্দা এনাক্ষী গোস্বামী জানাচ্ছেন, “আমি এখন কর্ম সূত্রে প্রবাসী, তবে যখনই বহরমপুর যাই এই আদি ঢাকা খাওয়ার আমায় ভীষণ টানে। পলতাপাতা এবং ডগার দিয়ে একটা তেতোর আইটেম করে, সেটা হটকেক পুরো।”

বাংলাদেশের বিভিন্ন রান্না আজও হয় এই হোটেলে, আর দাম সাধ্যের মধ্যেই। যদি এখনো শহর বহরমপুরের আদি ঢাকা হিন্দু হোটেলে ওপার বাংলার বিভিন্ন রান্নার স্বাদ না উপভোগ করে থাকেন তাহলে আজই ঢুঁ মারতে পারেন এই হোটেলে ।

 

বহরমপুর রানিবাগান মোড়ের এই ভাতের হোটেল শহরের সব থেকে পুরোনো ভাতের হোটেল বলেই দাবি করছেন হোটেল কর্তৃপক্ষ । পুরোনো ক্রেতাদের মধ্যে অনেকেই বলছেন কেউ ২৫ বছর বা কেউ ৩৫ বছর ধরে আসেন। আবার কেউ বলছেন আগে বাবার সাথে আসতাম এখন নিজের পরিবারকে নিয়ে আসি। এই হোটেল যেন বহু প্রজন্মের সাক্ষী । যারা  নিয়মিত গ্রাহক তাঁরা বলছেন “এই হোটেলর সাথে এখন আত্মীয়ের সম্পর্ক হয়ে গেছে। এঁরা খুব যত্ন করে আমাদের।”

আদি ঢাকা হিন্দু হোটেল নামটার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ওপার বাংলার এক অন্য ছাপ। লকডাউনে  কিছুটা সমস্যার মুখে পরলেও আবারও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে আদি ঢাকা হিন্দু হোটেল।এই হোটেলও শহরের এক অন্য ঐতিহ্য  ও ইতিহাস বহন করে চলেছে ।