দুয়ারে সংক্রান্তি , পৌষের পিঠেপুলির দিনগুলি আজ কেমন !

Published By: Madhyabanga News | Published On:

রাহি মিত্রঃ শীতের রাণী পৌষ মাস হল লক্ষ্মী মাস । বাড়ির বড়দের মুখ থেকে এমন কথা শুনে এসেছি সেই কবে থেকেই । পৌষ মাসের একেবারে শেষের দিনটি পৌষ সংক্রান্তি৷। এই দিনটির তাৎপর্য আমাদের বাড়িতে বেশ ভালই ছিল সেই সেদিনের দিন গুলোতে ।
সংক্রান্তির আগের দিন থেকেই বাড়িতে একটা ব্যস্ততা লক্ষ্য করতাম । অনেক বাজার আসতো সেদিন বাড়িতে । বাড়ির বড় কাঠের কালো রংয়ের আলমারিটা থেকে বড় বড় বাসনপত্র পেতলের , শ্বেত পাথরের বেড়োতো । সে গুলোকে মেজে ঝকঝকে করে তৈরি রাখা হতো । ঠাকুর ঘরের জিনিসপত্র ঝেড়েঝুড়ে ঠিক মতো করে রাখা হত। আর দেখতাম মা কে । বেশ ব্যস্ত হয়ে সব কাজগুলো সেরে ফেলার চেষ্টা করতেন । বড়দি কে বলে বলে দিতে থাকতেন মা কাজ কর্ম । তবে নিজেই কাজ বেশি করতেন । মা আবার কারোর করে দেওয়া কাজে সন্তুষ্টি দেখাতেন না । তাই ছোট থেকেই লক্ষ্য করেছি মা কেমন যেন দশ হাতে সবদিক সামলাতেন কার্যত দুটো হাত দিয়েই । সে যাই হোক ,
পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন আমাদের বাড়িতে চলত ভিজে আতপ চাল শিলে গুঁড়ো করবার পর্ব । কোনো যন্ত্র বা মেশিন নয় । অবশ্য সেই সব দিন গুলোতে তো আর এখনকার মত রান্নাঘরে মিক্সার গ্রাইন্ডার এর প্রবেশ ঘটে নি । আজ বুঝি গৃহকর্ম কিন্তু অনেকটাই পরিশ্রমসাধ্য কাজ । কারণ যন্ত্র যেসব গৃহে বা রান্না ঘরে প্রবেশ করেনি , সেসব গৃহস্থালির কাজে যথেষ্ট শ্রম দিতে হয় । তাই আমাদের মাসিমা কাকিমা মামিমা রা কঠোর পরিশ্রম করেই বলা যায় একান্নবর্তী পরিবার বা দশ থেকে বারো ভাইবোনের পরিবার সামলে নিতে পারতেন । আমার শোনা কথা , আমার এক মামিমা যিনি সারাদিন সংসারের সব কাজ সামলে বাচ্চা থেকে বড়দের সব চাহিদা পূরণ করার পরই রাতের বেলা সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে বসতেন আগের দিন ভেজানো কলাইয়ের ডাল

বাটতে বরি দেবেন বলে । সারা রাত্রি ধরে তিনি বড়ি দেবার ডাল বেটে তাতে চাল কুমড়ো কোরানো মিশিয়ে আর অন্যান্য সব মসলা মিশিয়ে রেডি করতেন । এসব করতে করতে শেষ রাত পার হয়ে ভোর হয়ে যেত । এরপর মামিমা পুকুর থেকে স্নান সেরে সূর্য ওঠার মধ্যেই ছাদে বড়ি মেলে দিতেন শুকোতে । সারা ছাদ জুড়ে কাপড় মেলে বড়ি দেওয়া আবার কাঠের আলমারি তেও বড়ি দিয়ে তিনি পুনরায় সারাদিনের কাজ শুরু করে দিতেন । কোন বিশ্রামের গল্প নেই আমার সেই মামিমার ডেইলি সিডিউলে । মা র মুখ থেকে শুনেছি এমন কথা । শুনে তো আমি থ্ । এমনই ছিলেন গৃহকর্ম নিপূণা আমাদের মা মাসীমা মামিমা রা ।

স্তূপীকৃত দুধসাদা চালবাটা তৈরি হয়ে গেলে তারপরে হত খোসা সমেত নারকেল ছাড়ানোর পালা । বড় সাড়াশি দিয়ে ছাড়ানো হত গোটা কুড়ি নারকেল। সেগুলো কুড়িয়ে নিতেন মা বড়দি মিলেই । বড় থালাতে ( পরাত) কলাপাতা দিয়ে ঢাকা থাকতো । আরো অনেক কাজ যেগুলো আমরা বিশেষ করে আমি দেখতাম। তবে যোগদান বিশেষ ছিলনা আমার তাতে । আসলে বাড়ির ছোট বলে আমাকে সিরিয়াসলি কোন কাজে অংশগ্রহণ করতে হত না । মা সবসময় ছাড় দিতেন আমাকে । পৌষের শেষে রোদের বারান্দায় দেখতাম সংক্রান্তির আগের দিন অনেক ধরনের ডাল মেলে দেওয়া থাকতো । সবই সংক্রান্তির পিঠের তৈরীর উপকরণ তা বুঝতাম ভালোই।

সংক্রানতির দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই মা বিছানা ছাড়তেন । সেদিন আবার পুজো থাকতো বাড়িতে । অনেক কিছু নিয়মকানুন । বাড়ির চারিদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । ঘুম ভেঙেই দেখতাম শেষ পৌষে ঠান্ডায় মা দিব্যি গঙ্গার স্নান সেরে চুল এলো করে বাড়ির কাজকর্ম করে চলেছেন৷। পৌষ সংক্রান্তির দিন আমাদের বাড়িতে দিনে খিচুড়ি রান্না হত আতপ চালের । দিনের খাওয়া-দাওয়ার পাট তাড়াতাড়ি চুকিয়ে মা কে দেখতাম রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেই আবার উনুন ধরানোর প্রস্তুতি

নেওয়ার ব্যবস্থা করতেন । সঙ্গে দুটো কেরোসিন স্টোভ । জ্বালানি গ্যাসের প্রবেশ তখন ঘটে নিয়ে আমাদের ছোটবেলাকার দিনগুলোর রান্নাঘরে । রান্না ঘরে বেশ কিছু মাটির তৈরি বাসনপত্র দেখতাম সেদিন । মাটির সরাতে হত আস্কে পিঠে । যেটার আবার দুটো ধাপ ছিল । মাটি সরাতে ভেজে নিয়ে শুকনো খেজুর গুড় দিয়ে খাওয়া , আর সেই ভাজা আস্কে পিঠে গুলোকে দুধ আর গুড় দিয়ে বানানো রসে ডুবিয়ে রাখা । তারপর খাওয়া । দুটোই ছিল দারুণ। পুলি পিঠে বানানো পর্ব টা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং ছিল । অসংখ্য পুলি পিঠে বানানো দেখতাম আর সবগুলি একই রকম দেখতে । বড় বড় পেতলের থালাতে (পরাত) এ সাজানো থাকতো । মাঝে মাঝে একটা দুটো নিজেও বানিয়েছি । তবে পিঠে তৈরি হয়ে যাবার পর নিজের বানানো একটু আলাদা করে পুলি গুলেকে আর কোনো সন্ধান পেতাম না চেষ্টা করেও । কত রকমের যে পিঠে হত কি বলবো ! আঁসকে পিঠে দু’রকমের , মুগডালের ভাজা পিঠে , চন্দ্রপুলি , রাঙা আলুর পিঠে , গোকুল পিঠে৷, কলাই ডালের পিঠে৷, তিলের পিঠে , নলেন গুড়ের পায়েস আরো অনেক কিছু।

আমাদের হলুদ রঙের দেওয়ালের রান্নাঘর ম ম করত পিঠের গন্ধে । খুব একটা জোরালো আমাদের রান্নাঘরে যদিও আলো ছিল না এখনকার মতো । এলইডি বাল্ব তো নয়ই আজকের দিনে মত । সেদিনের দিনগুলোতে হলদে রঙের আলো দেওয়া বাল্ব গুলো জ্বলতো রান্নাঘরে । তবে সে সময় লোডশেডিং হয়ে যেত মাঝে মাঝেই । তখন ভরসা ছিল হারিকেন আর কুপির আলোয় । আমাদের বাড়িতে অবশ্য হ্যাজাক ছিল আর কার্বাইড এর জ্বলা বাতিগুলো ছিল । তবে রান্নাঘরের ছিল লম্বা ধরনের পেতলের কুপি । লোডশেডিং হলে রান্নার কাছে মা কুপি জ্বালাতেন । আর আমরা মাঝে মাঝেই সেই কুপির আলোতে রান্নাঘরে উনুন এর কাছাকাছি বসতাম শীতের রাতে । পিঠে পুলির দিনে পৌষ সংক্রান্তির দিন তো কথাই নেই । রাতে মা

আমাদের তাড়াতাড়ি খেতে দিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। কারণ সব মিটতে মিটতে নাকি অনেক রাত হয়ে যেতো । যদিও শেষ পর্যন্ত দেখা আমার আর হয়ে উঠত না । তার অনেক আগেই ঘুমোতে পাঠিয়ে দিতেন মা । ওই যে আগেই বলেছি বাড়ির ছোট সদস্য হবার কারণে সিরিয়াস কোন কাজ বা বিষয়ে আমি থাকতাম না । বলাই বাহুল্য পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির দিনে আমাদের বাড়িতে রীতিমতো পারিবারিক উৎসবের আমেজ বয়ে যেত ।

সংক্রান্তি পরের দিন বাসি পিঠে নিয়েও অনেক কিছু চলত বাড়িতে । পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ি দেওয়া হতো বাসি পিঠেপুলি। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি পাঠানো হতো । আমাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মীদের বাসি পিঠে খাওয়ার আমন্ত্রণ আগেই জানানো থাকতো । তারা সকলেই চলে আসতেন বাড়িতে। এসবই আমি দেখতাম, আর দেখতাম আমার মাকে, বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের কেমন দশভূজা হয়ে গৃহকোণ নিপুণ হাতে সামলাতেন । তাঁরা তাঁদের সব এনার্জি নিয়োগ করতেন গৃহকর্মে । কারণ আজকের দিনের মতো সেদিন গৃহকর্মে যন্ত্রের প্রবেশ ঘটে নি তাই সেদিনের গৃহকর্ম ছিল যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য ।

শুক্রবারের মকর সংক্রান্তির দিনের কথা ভাবতে ভাবতে সেই সেদিনের পৌষ সংক্রান্তির দিনে ফিরে গেছিলাম। যদিও আজকের হেলথ কনসাসনেসের দিনে পৌষ সংক্রান্তি ম্লান । শহর অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি জন তো বলতেই পারবেন না ঠিক কবে পৌষ সংক্রান্তি । গ্রামের দিকেএ নৈব নৈব চ । তবে গ্রামের দিকে যাঁদের ধানে জমি আছে , তাঁরা পৌষ পার্বণের দিনক্ষণ বলতে পারলেও ব্যাস এইটুকুই । সেই সেদিনের মত পিঠে পুলি উৎসব আজ আর গ্রামের দিকেও নেই বললেই চলে। বহু মানুষই আজ কাছের মিষ্টির দোকান থেকে কেনা পিঠে দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছেন  পৌষের মরসুমটা । তবে জেলা থেকে রাজ্য অপর রাজ্যেও কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে পৌষ পার্বণ ভিন্ন ভিন্ন নাম নিয়ে পালিত হয়

ভারত বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে মকর সংক্রান্তি পালিত হয় । প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে মকর সংক্রান্তির ‘ সাকরাইন ‘ নামে পরিচিত । পশ্চিম ভারতের গুজরাটে বড় পরিসরে পালিত হয় মকর সংক্রান্তি । প্রতিবেশী দেশ নেপালে দিনটি ‘ মাঘি ‘, থাইল্যান্ডে ‘ সংক্রান ‘, মায়ানমারে ‘ থিংইয়ান ‘ কম্বোডিয়া ‘ মহাসংক্রান ‘ নামে পালিত হয়।

মকর সংক্রান্তি নামের তাৎপর্য হিসেবে বলা হয় এদিন সূর্যদেব ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে । সারা বছর জুড়ে সূর্য বারোটি রাশির মধ্যে দিয়ে যায় আর যে রাশিতে প্রবেশ করে তাকে তার সংক্রান্তি বলা হয়। মকর সংক্রান্তি ১৪ অথবা ১৫ জানুয়ারি তেই হয়ে থাকে।