সীমান্ত নন্দী: দশমীর প্রায় ভোর থেকেই সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন সাইটগুলিতে ‘ আবার এসো মা ‘ ‘ শুভ বিজয়া ‘ বা ছলছল চোখের দুর্গার ছবিতে মুখে সিঁদুরে মাখামাখি মার্কা ছবি । দশমীর সারা দিন চলল এমনই । সাথে গঙ্গা ঘাটের ভিডিও । বিকেল থেকে শুরু হয়ে গেল প্রীতি ও শুভেচ্ছা সহ নানা ধরনের শুভ কামনার বন্যা। ইন্টারনেটে ৫ জি এসে পড়েছে নাকি , আর প্রধানমন্ত্রী নাকি তা উপহার দিচ্ছেন বলে বলেছেন । সবটাই শোনা কথা তবে । সে প্রধানমন্ত্রী উপহার দিন বা নাই দিন ডিজিটাল বিশ্বে বসবাসকারি আমরা ডিজিটাল ফেস্টিভ্যাল শেষ করে এবার ডিজিটাল বিজয়ার শুভেচ্ছা তে প্রবেশ করে আছি । চলবে সেই দীপাবলীর আগে পর্যন্ত তবে এই ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজয়ার শুভেচ্ছা ভালোবাসা বিনিময় টা খুব একটা মন্দ তা কিন্তু নয় । মন্দ নয় এই অর্থে যে , কোনো হ্যাপা নেই । নেই মাইক্রো ব্যস্ততার যুগে নাড়ু মুড়কি বানানোর ঝামেলা । এই আর কি ! আগে মানে এই আশির দশক থেকে নব্বই এর দশক বা তার ও পরে যা দেখেছি দশমীর দিন থেকে , তা এককথায় জমজমাটি যাকে বলে । বড় বড় গামলা ভর্তি করা নাড়ু নানা ধরনের । চিড়ে ভাজার নাড়ু , তিলের নাড়ু , মুড়ির নাড়ু , গজা , জিভে গজা , চিনি দেওয়া নিমকি আরও কত কি ! বানানো হতো দশমীতে সেসব চলত সেই কালীপুজো পর্যন্ত । কারণ বিজয় পর্ব চলত সেই কালীপুজো পর্যন্তই । তা এই মধ্যের দিনগুলিতে যত লোকজন আত্মীয় স্বজন আসবে সকলকেই দিতে হবে নাড়ু মুড়ি মুড়কি সহ বড়ো একখানা প্লেট ভর্তি খাবার দাবার । শুধু কি অতিথিদের দেওয়া আরও অনেক ধরনের মানুষজন আসতেন , যাঁদের দিতে হতো বিজয়ার নাড়ু মুড়কি ভরা প্লেট। তাদের কেউ কেউ বসে খেতেন । কেউ বা আবার বেঁধে নিয়ে যেতেন সাথে করে । কী যে মজার দিন ছিল সে আর কি বলব !
তবে এবার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ফেসবুক সহ আরো সব জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমের পাতাগুলি ভরে গেছে অবশ্য পোস্ট করা হাঁড়ি হাঁড়ি রসগোল্লা আর নাড়ু ভর্তি প্লেটে ।
একাদশীর ভোরে চোখ খুলে ফোনটা খুলতেই গোটা দশেক প্লেট ভর্তি নাড়ু আর সাথে আবার গোটা পাঁচেক চকোলেট পেয়ে ভাবছি , খাব না দেখবো , দেখব নাকি খাব ! আসলে ঘুম চোখে ছবির খাবারগুলোকেও খাওয়ার বাসনা জাগছে এই আর কি । ঘুম পুরোটা কাটতেই ধাতস্থ হয়ে আগে খাবার-দাবারের ছবিগুলোকে উড়িয়ে দিলাম ফোন থেকে । সাথে সাথে মনে পড়ে গেল সত্যি যেবার প্লেট ভর্তি বিজয়ার নাড়ু পেয়েছিলাম সেইসব দিনের কথা । শুধু কি পেয়েছিলাম , সাথে মনও ভরিয়ে ছিলাম তো ।
প্রযুক্তি দিচ্ছে কত , আর নিচ্ছেই বা কত আমাদের ? সেই ভাবনা কি আর কেউ আজ ভাবে বোধকরি ভাবে না ।
আসলে ভাবনার বড় অভাব আজ । আর তার থেকেই যত বিপত্তি । সেই যে ঋত্বিক ঘটকের সেই সেই লাইনটা , ” ভাবো ভাবো ! ভাবা প্র্যাকটিস করো ” কিন্তু কে করবে ভাবা প্র্যাকটিস ?
কত দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে সামাজিক রীতি রেওয়াজ গুলোর ! এইতো এক বছর আগেও পরিচিত নিকট আত্মীয় স্বজন ফোন করে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানাতো , কুশল আদান-প্রদান হত । গলার স্বর টুকু পাওয়া যেত ফোনের ও প্রান্ত থেকে৷। সামাজিক মাধ্যমে যেন তাও নিঃশেষ হয়ে গেল । ওন্যের করা পোস্ট ফরওয়ার্ড করে দায় শেষ যেন সৌজন্যবোধের ।
তবু নিতে হবে , দিতেও হবে এভাবেই । কারণ আমরা ডিজিটাল সৌজন্যবোধের আওতায় এখন ।
প্রযুক্তি যেমনভাবে সৌজন্যে দেখাতে শেখাবে প্রাণীশ্রেষ্ঠ তো সেভাবেই শিখবে ।
পরিবর্তনই তো জগতের নিয়ম । যুগের ধর্ম ।