আমাদের মফঃস্বলী জনপদে ছবি আঁকার কথা বললে অধিকাংশজনেরই মানসপটে ভেসে ওঠে একটি সাপ্তাহিক ক্লাস, যেখানে আম, কলা, আপেল, কুঁড়েঘর, সিনারি ইত্যাদি আঁকতে শেখানো হয়। তাই ‘ছবি আঁকি’ কথাটা বললেই পরবর্তী প্রশ্নটা অনিবার্যভাবেই ধেয়ে আসে ‘ও আপনি আঁকা শেখান?’ অথচ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিলকে কিন্তু কেউ কখনও জিজ্ঞেস করেন না, তাঁরা চিকিৎসাবিদ্যা, আইন বা প্রযুক্তিবিদ্যা শেখান কিনা? চিত্রশিল্পীদের বেলায় প্রশ্নটা ওঠে তার কারণ, আসলে ছবির কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা নেই অধিকাংশ মানুষের জীবনে। তাই শুধু ছবি এঁকে কিভাবে টিকে থাকতে পারে একজন চিত্রশিল্পী সেটা ভেবেই উঠতে পারে না আশপাশের মানুষ। ফলত এখানে যাঁরা ছবি আঁকেন তাঁরাও জীবনটা ক্রমশ আম, কলা, আপেল, সিনারিতেই উৎসর্গ করে দেন। অন্যদিকে কেতাবি-শিক্ষার গর্ব আছে যাঁদের, তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভাবেন, যাদের পড়াশোনায় মাথা নেই তারাই ছবি আঁকে। এইসব কথাগুলো কোনো কষ্টকল্পনা থেকে বলছি না, একেবারে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই লিখছি। আমার এই লেখার পাঠক যদি এইরকম চরিত্রের না হন, তাহলে প্রথমেই তিনি আমার নমস্কার ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।
এখন এইরকম একটা বাস্তব পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ছবি এঁকে আমি ও আমার কতিপয় বন্ধু ঠিক কি করতে চাইছি সেটা একটু বলতে চাই। কলকাতার সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ থাকলেও মূলত আমি বহরমপুরের মানুষ। আমার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সহশিল্পীদেরও অনেকেই মুর্শিদাবাদ জেলার। সুতরাং একথা গোড়াতেই কবুল করে নেওয়া ভালো যে বড়ো-শহরের ধনীসমাজের সঙ্গে ওঠাবসা ছাড়াই আমাদের প্রতিদিনের ছবিজীবন অতিবাহিত হয়। ব্যাপারটা বাস্তবে কিছুটা কঠিনই। কারণ লেখার শুরুতেই বলেছি চিত্রকলা সম্পর্কে আশপাশের সাধারণ মানুষের মনোভাব ঠিক কিরকম? এই অবস্থায় বহুকাল ধরেই আমি ও আমার কিছু বন্ধু ছবিকে আমাদের অন্তরের ভাবনা ও বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছি। বিশেষত বড়ো বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনায় আমরা আমাদের অভিব্যক্তি ছবির মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করি। কারণ ছবি আসলে একটা ভাষা। বলা ভালো অন্যতম আদিমভাষা। বাংলা, ইংরেজি, আরবি তো দূরের কথা সংস্কৃতর চেয়েও কয়েক হাজার বছরের পুরোনো হল চিত্রভাষা। স্বভাবতই আমি সেই ভাষায় আমার আনন্দ বেদনা হতাশা অভিমান রাগ প্রকাশ করে তৃপ্তি পাই।
ছবিকে যারা ভাব প্রকাশের বাহন বলে ভাবতে পারেন না তাঁরা চিত্রকলাকে কৃত্রিম একটা নন্দনতত্ত্বের মোড়কে পুরে পরিবেশন করেন। বলাবাহুল্য এইসব শিল্পীদের জন্যই ছবি থেকে সাধারণ অথচ অনুভবী মানুষেরা বহুদূরে সরে গেছেন। বেশিরভাগ মানুষই এমনকি আমাদের স্থানীয় শিল্পীবন্ধুরাও বেশিরভাগই ভাবতে পারেন না ছবি এঁকে কি করে মনের সবকিছু প্রকাশ করা যায়। তাই বড়োসড়ো কোনো সামাজিক গর্বের কিংবা মর্মস্পর্শী নিষ্ঠুর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় দেখা যায় বেশিরভাগ শিল্পীই উদাসীন থাকেন। রাজধানীর রাজপথে কোনো মেয়ে ভয়ঙ্করভাবে লুণ্ঠিতা হলে কিংবা আন্তর্জাতিক আঙিনায় কোনো সফল খেলোয়াড়ের নেপথ্য শ্রম আমাদের ছবির বিষয় হয়ে ওঠে না। এই বিষয়টি নতুন করে প্রত্যক্ষ করছি গত দেড়- দু’বছর ধরে। সত্যিকথা বলতে কি আমাদের জীবনে এমন দুঃসময় আগে কখনও আসেনি। আমরা যারা পরাধীন দেশে বিদেশি শাসকের হাতে লাঞ্ছিত হইনি, দেশভাগের যন্ত্রণা সহ্য করিনি, বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপের আঁচ পাইনি, জাতিদাঙ্গায় সরাসরি বিপন্ন হইনি তাদের কাছে করোনাকাল নিঃসন্দেহে এক ভয়ঙ্কর সময়। কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি একটি ভাইরাসকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে অনাচার, যে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয়েছে তার শিকার কমবেশি আমরা সবাই।
রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে বণিক সম্প্রদায়, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বিত্তশালী ব্যক্তি সবাই এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে ও এখনও নিয়ে চলেছে। অসংখ্য মানুষের জীবন, জীবিকা বিপন্ন। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজগৎ ভেঙে চুরমার, মানুষের মূল্যবোধ ধ্বংসের মুখে। এইসবই আমরা প্রতিদিন নানাভাবে দেখে চলেছি। আমাদের নাগরিকত্ব অনিশ্চয়তায়, আমাদের ধর্ম পরিচয় নিয়েও একে অপরের মনে শ্রদ্ধার অভাব, প্রশাসন রাজনৈতিক দলের দাসত্ববৃত্তি করে চলেছে, স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে পানীয় জল প্রায় কিছুই এখন আর বিনে পয়সায় পাবার উপায় নেই। চতুর্দিকে বিচিত্র আতঙ্কে মানুষ কাঁপছে। এমনকি প্রকাশ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও হাজার নিষেধাজ্ঞা।
এইরকম বিশ্রী একটা সময়ে দাঁড়িয়ে কিসের ছবি আঁকতে পারে আমার মতো একজন মানুষ? স্বাভাবিকভাবেই তাই দিনের পর দিন ধরে এঁকে চলেছি সমকালের ছবি। কেমন ছবি সে-সব? মাস্ক দিয়ে ঢাকা যায় না যাদের দৈন্য, তাদের মুখ। ভাতের কাছে পৌঁছানোর আগেই যে-সব পরিযায়ী মানুষগুলো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল তাদের চটিজুতোর ছবি। স্বাধীন দেশের নাগরিকদের শবদেহর ওপর দিয়ে হেঁটে যায় যে দেশরক্ষী তার পদচারণার দৃশ্য। আঁকি সেই দেশপ্রেমের পতাকা, যাকে ওড়াতে গেলে প্রাকৃতিক হাওয়ায় চেয়ে নির্ভর করতে হয় কৃত্রিম হাওয়ার ওপর। পতাকার সঙ্গে আঁকি বৈদ্যুতিক বাতাসটিকেও। আঁকি জিপের চাকায় ভেঙে যাওয়া লাঙলের ছবি। আবার তারই পাশাপাশি লাঙল পিঠে নিয়ে দিগন্তরেখায় ঘোড়াদের দুরন্ত দৌড়টিকেও এঁকে রাখি। আঁকি তিরবিদ্ধ ভূপতিত বই, ক্লাসরুমের বেঞ্চ জুড়ে ব্যাঙের ছাতা। আমার বন্ধু মিজানুর খান আঁকে লাঙলাকৃতি ক্রুশকাঠে বিদ্ধ কৃষক। সৌম্যেন্দ্রনাথ মণ্ডল রচনা করে শূন্যতায় ভাসমান বুভুক্ষু বালক ও খাবার-পাত্র। সুগত সেন তাঁর ছবিতে দেখান দেশের সীমান্তে কাঁটাতারের পাশে মানুষ রূপান্তরিত কাকতাড়ুয়ায়। কার্তিক পাল-এর ছবিতে উল্টে যাওয়া ছাতার নীচে বিবর্ণ মানুষ। এসব ছবির কোনোটিই ড্রয়িং রুমে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়, বরং হৃদয়ের অন্তঃপুরকে সজাগ ও সতর্ক করে দেওয়াই তাদের কাজ। চিরদিনই দেশ ও জাতির সংকটকালে শিল্পীর কাছে বিপন্ন সমাজের এটাই দাবি। আর সেই দাবি পূরণেই আমাদের যাবতীয় তৎপরতা।
(কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত এই সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ চিত্রশিল্পী। কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্তের ছবি সময়ের কথা আমাদের সামনে নিয়ে আসে )