তুহিন শুভ্র: পাঠক মহলে ভ্রমণ কাহিনির চাহিদা চিরদিনের। ভ্রমণ-অ্যাডভেঞ্চারকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নানান প্রান্তের লিখিয়েরা কালজয়ী সব ট্র্যাভেলগ উপহার দিয়েছেন পঠককে। শব্দ-বাক্যের বর্ণনায় লেখক ভ্রমণসঙ্গী করে নিয়েছেন তাঁর পাঠকদেরও। কখনও কখনও শব্দ-বাক্যের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে বর্ণনাকারী নিজেই হাতে তুলে নিয়েছেন রঙ, তুলি, পেন্সিল। ভ্রমনমূলক লেখার দুনিয়ায় লেখকের শিল্পীসত্ত্বা উন্মোচনের দৃষ্টান্তও যেমন রয়েছে, তেমনি ঠিক এর বিপরীত দৃষ্টান্তও রয়েছে। একজন চিত্রশিল্পী যখন রঙ-তুলি, পেন্সিলে ভ্রমন কাহিনি লিখতে বসেন, তখন সে কাহিনি শুধু আর একমাত্রিক বর্ণনা থাকে না। তা হয়ে ওঠে দৃশ্যগত বহুমাত্রিক ন্যারেটিভ।
শিল্পীর রঙ-তুলিতে ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রসঙ্গে এই সময়ের একজন চিত্রশিল্পীর উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি হলেন শিল্পী দেবাশীষ দেব। কার্টুনিস্ট হিসেবেই তিনি অধিক জনপ্রিয় যদিও বা, তবে তাঁর ‘বেড়ানোর ডায়েরি’, ‘চরৈবেতি’ ইত্যাদি ছবির বুনোটে ঠাসা ভ্রমণমূলক বই খুব সহজেই পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। মধ্যবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার এমনই এক প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত সম্প্রতি কাশ্মীর বেড়াতে গিয়ে ভূস্বর্গকে নিয়ে একটি ছবির সিরিজ এঁকে ফেলেছেন। সিরিজটি মূলত দুটি অ্যালবামে বিভক্ত। ভূস্বর্গের নয়নাভিরাম নিসর্গ-দৃশ্যকে ধরেছেন ‘জলরঙের দেশ’ নামক অ্যালবামে। আর সাদা-কালো অপর অ্যালবামটির নাম দিয়েছেন ‘পাহাড়ি’, যার বিষয় ভূস্বর্গের মানুষ ছাড়া আর কী বা হতে পারত!
শিল্পী কৃষ্ণজিৎ ছবি আঁকার পাশাপাশি লেখালেখিতেও যে সিদ্ধহস্ত, বিদগ্ধ মহলে সেকথা আর অজানা নয়। ইতিমধ্যেই ছবি বিষয়ে তিনি প্রায় খান-দশেক বই লিখে ফেলেছেন। কাশ্মীর সিরিজে এহেন শিল্পীর দেওয়া একেকটি ছবির শিরোনাম যে একেকটি স্বতন্ত্র কবিতার মতো হয়ে উঠবে, তাতে আর আশ্চর্য কি? জলরঙে আঁকা একটি ছবিতে দেখা যায় শুভ্র বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে মাটিতে লুটানো মায়ের আঁচলের মতো শান্ত নদীটি বয়ে চলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুয়েকটি নির্জন গাছ। এই ছবির নীচে লেখা নিতান্ত সহজ দুটি বাক্য— ‘এখানে ভালোবাসার উত্তাপে নদীর জন্ম। গাছ জানে সে কথা।’ দর্শকমন ততক্ষণে হয়ত বা পরবর্তী ছবির দিকে অগ্রসরমুখী, কিন্তু পাঠকমন আটকে যাবে বাক্যদুটির উচ্চারণ-অনুরণনে— একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। শিল্পী কৃষ্ণজিতের ছবি ও লেখা যাঁরা দেখেন, পড়েন, তাঁদের কাছে এহেন অভিজ্ঞতা নতুন নয়। ‘পাহাড়ি’ অ্যালবামের সেই ছবিটির কথা উল্লেখ করতেই হয়, যেখানে ডাললেকের এক ভাসমান ডিঙিতে বসে আছেন মাথায় ফেজটুপির একজন অশীতিপর বৃদ্ধ। হাতের বৈঠাখানি জল থেকে আলগোছে তুলে রেখেছেন। দৃষ্টি দূরে, উদাসীন। এভাবে কতক্ষণ নিশ্চুপ বসে আছেন কে জানে! তাঁর কি কোথাও যাবার নেই? নাকি অতীতের কোনো বাদশাহী বৈভবস্মৃতি বর্তমানের অস্তিত্ব সংকটের প্রেক্ষিতে এই বৃদ্ধকে ভীষণ পীড়া দেয়? এ ছবির নীচে শিল্পী লিখেছেন— ‘তিনি ডিঙিচালক, সারাদিন ডাললেকের বুকে টলমলে ছায়া ফেলে ঘুরে বেড়ান। ওঁর নাম রেখেছি আকবর।’ ছবির পরিসর তখন মার্জিন অতিক্রম করে ইতিহাসকে ছুঁয়ে ফেলে না কি?
এমন অনেক অনেক ছবি এবং প্রতিটি ছবির সাথে জুড়ে থাকা ছবির আত্মকথার মতো দুয়েকটি লাইন সিরিজটিকে ডকুমেন্টরির রূপ দিয়েছে। কাশ্মির সিরিজের পিডিএফ সংস্করণ ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে যার কোনো বিনিময়মূল্য নেই। সিরিজটি ছাপা হয়ে সুদৃশ্য ও সংরক্ষণযোগ্য আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।
তুহিন শুভ্র সঙ্গীত শিল্পী ও সমালোচক । বহরমপুরের বাসিন্দা। (মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)