কমেছে ভাড়া,নেই যাত্রীও! রিক্সা চালকদের ভুলে যাচ্ছে শহর

Published By: Madhyabanga News | Published On:

রাহি মিত্রঃ দিন প্রতি মালিককে দিতে হয় কুড়ি টাকা । তা বাদে আমার হাতে থাকে আশি টাকা । যেদিন একশো টাকা রোজগার হয় সেদিন । আর যেদিন একটু বেশি মানে দেড়শো টাকা মতো হয় রোজগার , সেদিন একটু বেশি টাকা থাকে হাতে । এই দিয়েই দিন চালাই ।
রিক্সাটাকে পাশে রেখে একটা ধাপিতে বসে এমন সব কথাই জানালো নিত্যদিন ভাড়া করা রিকশা চালিয়ে বেড়ানো সুকদেব হাজরা ।
শুনে বিষম অবাক হবারই কথা ! দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির এই দুর্দিনে সারাদিন রিক্সা চালিয়ে এই কটা টাকা রোজগার আর তা দিয়ে কিনা সংসার চালানো ! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে আরও যা কিছু জানা গেল সুকদেব হাজরার কাছ থেকে, শুনে বড়ই হতাশ হতে হলো । অবশ্য এই হতাশাই তো এখন কর্মসংস্থানের বাজারে একমাত্র পাওয়া নিম্নবিত্ত থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষজনদের ।

একটানা ৪৩ বছর ধরে শহর বহরমপুরে রিকশা চালাচ্ছেন এলাকার সকলেই পরিচিত মুখ সুকদেব হাজরা । আজ পয়ষট্টি বছর বয়সেও কাকভোরে উঠে সকাল ছটা তেই বহরমপুর জগন্নাথ ঘাট এলাকায় মালিকের কাছ থেকে ভাড়া করা রিক্সাটা নিয়ে নেন সুকদেব । এরপরই দ্রুত চলে আসেন কল্পনার মোড় এলাকায় । কিছু দিন আগেও যেখানে রিক্সা স্ট্যান্ড ছিল । সার দিয়ে অনেক রিকশা দাঁড়িয়ে থাকতো ভাড়া ধরার জন্য । সুকদেব তার রিক্সা নিয়ে কল্পনা মোড়ের বাজার ফেরত লোকেদের ভাড়া গুলি ধরার চেষ্টায় থাকেন । সকালটা তে ধরেন ও কিছু কিছু বাজার নিয়ে ফেরা মানুষজনের ভাড়া । যেগুলি কাছাকাছি এলাকার মধ্যে । এরপরে হয়তো কোনদিন ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলে গোরাবাজার দিকের ভাড়াও পান সুকদেব । আবার খাগড়ার দিকে , সৈদাবাদ কুঞ্জঘাটার দিকের ভাড়াও পান মাঝেমধ্যে । সে দিনগুলোতে একটু বেশি রোজগার হয় তার । তবে বেশি বলতে তা এখন এই টোটো রাজের বাজারে একশো থেকে দেড়শ টাকা ছাড়ায় না কখনোই । নিজেই জানালেন সুকদেব এই কথা । তবে এলাকায় টোটো গাড়ি আসার আগে কিন্তু সুকদেব ভালোই রোজগার করতেন দিনে । স্বীকার করলেন তিনি । টোটো গাড়ি বাজার দখল করবার আগের দিনগুলিতে দিনে সাড়ে তিনশো থেকে চারশো টাকা পর্যন্ত রোজগার করেছেন সুকদেব রিকশা চালিয়ে । সেই টাকায় সংসার যে ভালই চলত তা হাসিমুখেই জানালেন তিনি । এক প্রকার আত্মতৃপ্তির ভঙ্গিতে সুকদেব জানালেন বাড়িতে তার স্ত্রী রয়েছেন আর এক ছেলে । এই নিয়েই তার পরিবার । পরিবারের সব রকমের চাহিদা তিনি রিকশা চালিয়ে পূরণ করেছেন একসময় । কোন অসুবিধে হয়নি । তবে এখনকার কথা বলতেই আবারও মুখে বিষাদ ছেয়ে এল শুকদেবের । জানালেন , এখন আর পারছি না এত কম টাকাতে সংসার চালাতে । তার ওপর বাজার দরে যেন আগুন লেগেছে । সব জিনিসের দাম এত বেশি যে সংসারে টানাটানি । একমাত্র ছেলে কাঁচা সবজির ব্যবসা করে ।

সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে টোটো গাড়ি চালান না কেন , এমন প্রশ্নের উত্তরে হতাশ সুরে সুকদেব জানালেন , সারা শহর জুড়ে এতো টোটো গাড়ি চলছে যে ভরসা পাই না , ঠিকমত প্যাসেঞ্জার পাব কিনা! তার ওপর ভাড়ার টোটো গাড়ির মালিককে প্রতিদিন আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা দিতেই হবে । তাই সাহসে কুলাচ্ছে না টোটো গাড়ি ভাড়া তে । দীর্ঘ বছর ধরে রিকশা চালিয়ে রিকশার উপর কেমন যেন একটা মায়া পড়ে গেছে শুকদেবের । রোজ সকাল ছটা থেকে সারা দিন রিক্সাটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা , আর ভাড়া পেলেই খুশি মনে নিয়ে যাওয়া । এই কাজের সাথে যেন নিজের মনেরও একটা যোগ পাই , এমন কিছু ভাবনার কথাই যেন উঠে এল সুকদেব হাজরার রিক্সা নিয়ে বলা কথা গুলো থেকে । কথার মাঝেই রিক্সায় বসার সিটের তলা থেকে মোছার কাপড়টা বের করে রিক্সার পিছন দিকটা মুছে নেন বেশ যত্ন করে ।

সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া অন্যান্য রিকশা প্যাডলারের কথাতে সুকদেব হাজরা নিজে থেকেই এলেন । উদাস স্বরে জানালেন আমরা দু তিন জন বন্ধু একসাথে চালাতাম রিক্সা । তবে তারা আর কেউই নেই আজ । রোগে ভুগে মারা গেছে । রোজগার পাতি কম থাকায় ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেনি ।
বার্ধক্য ভাতা টুকু পান । এর বাইরে আর কোনো সরকারি বা অন্য কোনো সাহায্য কখনো পাননি সুকদেব । জানালেন নিজেই । শরীর তেমন খারাপ না থাকলে রোজই রিক্সা নিয়ে বের হন শুকদেব। তবে মেঘ-বৃষ্টির দিনগুলোতে ভাড়ার রিক্সা নেন না । একে তো প্যাসেঞ্জারই পান না , তার ওপর মালিককে কুড়ি টাকা দিন প্রতি দিতে হয় । মেঘ-বৃষ্টির দিনে তো একজন প্যাসেঞ্জার ও যাবেনা রিক্সাতে । তাই সেদিন বাড়িতে বসেই কাটান সুকদেব হাজরা ।

মানব চালিত মনুষ্যবাহী ত্রিচক্রযান ঐতিহ্যবাহী এই রিক্সা কিন্তু পালকি পরবর্তীতে দুই বাংলাতেই যথেষ্ট প্রয়োজনীয় যান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল এক সময়। তবে প্রযুক্তি আর যন্ত্রের যুগে মনুষ্য চালিত যান হিসেবে পিছিয়ে পড়ে রিক্সা । সে জায়গা আজ ই রিকশা অনেকটাই দখল করে নিয়েছে । তাই পরিবর্তনের ধারা মেনে সুকদেব হাজরা রা আজ ক্রমশ পিছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন । তবু তিন চাকার মায়াতে জড়িয়ে আজও ভোর হলেই ক্রিং ক্রিং ক্রিং শব্দে বহরমপুরের অলিতে-গলিতে পৌঁছে দেন দুই-একটি প্যাসেঞ্জার কে । এতেই যেন শান্তি চৌষট্টির কোঠায় সুকদেব হাজরার ।