উৎসবে নেই নতুন জামা, বাড়েনা মজুরি, পড়া ছেড়ে বিড়ি বাঁধছে সুস্মিতারা

Published By: Madhyabanga News | Published On:

দেবনীল সরকারঃ  উৎসবে মজেছে রাজ্য। টিভি খুললেই ঢাকে  পড়ছে কাঠি।  ব্যস্ত শহর ছুটছে পুজোর আনন্দে। কিন্তু এই আনন্দ কি ছুঁয়ে যাচ্ছে বিড়ি মহল্লা ?  কেমন আছে বিড়ি শ্রমিকরা ?  খবর নিতে ঢুঁ মারা মুর্শিদাবাদের নিমতিতা গ্রাম পঞ্চায়েতে । নিমতিতা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধিকাংশ (প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষের) পেশা বিড়িবাঁধা। গ্রামের যুবকদের একাংশ যদিও মৎস্যজীবী।  তবে এই এলাকায় এখন মৎস্য জীবিদের  অবস্থা ভালো নয়। তাই ফাঁকা সময়ে দালানে বসে বাড়ি মা বোনের সাথে বিড়ি বাঁধেন তারাও। বাড়ির বৃদ্ধ থেকে শুরু করে মেয়েরাও বিড়ি বাঁধেন। কেমন আছেন বিড়ি শ্রমিকেরা! কত মজুরি পান? পুজোর আগে কী অবস্থায় আছেন নিমতিতা গ্রাম পঞ্চয়েতের হাটপাড়া এলাকার বিড়ি শ্রমিকেরা!

নিমতিতা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধিকাংশ পেশা বিড়ি বাঁধা। ছবিঃ ময়ূরেশ রায়চৌধুরী

বিড়ি বাঁধা হয় বাড়িতেই। নিজের হাতে পাতা কেটে, মশলা তৈরি করে বিড়ি প্রস্তুত করেন বিড়ি শ্রমিকেরা । গ্রামে গ্রামে আছে মুন্সিরা। যাঁরা পাতা ও তামাক সরবরাহ করেন শ্রমিকদের। মুন্সিদের কাছ থেকে পাতা নিয়ে এসে বাড়িতে বিড়ি প্রস্তুত করেন তাঁরা। তারপর প্রতি সপ্তাহের শেষে মুন্সিরা এসে বিড়ি হিসাব করে তাঁদের টাকা মিটিয়ে, সেই বিড়ি নিয়ে চলে যান বড়ো বাজারে। সেখানে বড়ো কোম্পানিতে প্যাকেজিং হয়ে বিড়ি ছড়িয়ে যায় দেশ বিদেশে। আর সব জিনিসের মতো বিড়ির জন্যেও রয়েছে নিদির্ষ্ট বাজার। তবে যাঁরা বিড়ি বাঁধেন নিজের হাতে করে। তাঁদের এহেন সমস্যা কেন? আসলে এই বিড়ি বাঁধার জন্য যে পরিমাণ অর্থ শ্রমিকরা পান তা শুধু কম নয় নিতান্তই সামান্য।

মুন্সিদের কাছ থেকে পাতা নিয়ে এসে বাড়িতে বিড়ি প্রস্তুত করেন তাঁরা। তারপর প্রতি সপ্তাহের শেষে মুন্সিরা এসে বিড়ি হিসাব করে তাঁদের টাকা মিটিয়ে, সেই বিড়ি নিয়ে চলে যান বড়ো বাজারে। ছবিঃ ময়ূরেশ রায়চৌধুরী

এক হাজার বিড়ি বাঁধার জন্য একজন শ্রমিক পান ১৭৫ টাকা। হ্যাঁ, মাত্র ১৭৫ টাকা। যেখানে বর্তমানে একটা বিড়ির বাজার মূল্য প্রায় ২টাকা। খুবই আশ্চর্য না! হ্যাঁ কিন্তু কিছু করার নেই, তাঁদের এই রকম ভাবেই চলে যাচ্ছে, বলেন প্রবীণ বিড়ি শ্রমিক সুশান্ত মুনিয়া। তিনি বলেন, “ তিন বছর আগে রেট ছিল ১৫০ টাকা ( ১০০০ বিড়ি বাঁধার) , মাস দুয়েক আগে ২৫ টাকা বেড়েছে মাত্র। যেখানে সব জিনিসের দাম লাফিয়ে বাড়ছে সেখানে বিড়ি শ্রমিকদের ২৫ টাকায় কী হবে! আমাদের কথা কেউ ভাবে না।এক সপ্তাহে ৬০০ টাকা আয় হয় কোনও রকমে।” করোনা লকডাউনের পর আরও শোচনীয় হয়েছে তাঁদের অবস্থা।

এক হাজার বিড়ি বাঁধার জন্য একজন শ্রমিক পান ১৭৫ টাকা। ছবিঃ ময়ূরেশ রায়চৌধুরী

সামনেই দুর্গাপুজো। পাড়ার ছোট্ট মণ্ডপে তৈরি হচ্ছে দুর্গা প্রতিমা। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি, কিন্তু এখনও বাড়ির ছোট বাচ্চাদের একটাও নতুন জামা কিনে দিতে পারেননি সনকা সিংহ ও তার মেয়েরা। বিড়ি বেঁধে যে টাকা পান নিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এই অবস্থা। তারপর এই বছর পুজো এগিয়ে এসেছে। প্রায় কুড়ি বছরেরও বেশিদিন ধরে বিড়ি বাঁধছেন তাঁরা। তবে এবছরের মতো খারাপ অবস্থা আগে কখনও হয়নি। এই অবস্থায় রোজকার খাবার জোগাড় করতেই মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে তার মধ্যে নতুন জামাকাপড় তো বিলাসিতা, বলেন বাড়ির কর্তা গোপন সিংহ।

পুজো এগিয়ে এসেছে। ছবিঃ ময়ূরেশ রায়চৌধুরী

গ্রামে রয়েছে একাধিক পুজো মন্ডপ, কোনওরকমে  পুজো করবেন গ্রামবাসীরা, কিন্তু ওই টুকুই। আর কোনো বাড়তি আনন্দের বালাই নেই এখানে। গ্রামের সবাই খুব উদাসীন এই শারদীয়ার প্রাক্কালে। এই রকমই এক পরিবারের মেয়ে সুস্মিতা হালদার। ক্লাস নাইনের ছাত্রী সুস্মিতা। পুজোর আগে যাতে বাড়িতে একটু বেশি টাকা আসে সেই তাগিদে স্কুলে না গিয়ে বিড়ি বাঁধার কাজে মায়ের সাথে কাজে হাত লাগিয়েছে সুস্মিতাও। সুস্মিতা এই প্রসঙ্গে বলে, স্কুলে যেতে তার বিশেষ ভালো লাগে না, তার মূল আগ্রহ ছবি আঁকাতেই। জিজ্ঞেস করলে ও বলে, ‘ বড় হয়ে আর্টিষ্ট হতে চাই ’।

বিড়ি বেঁধে যে টাকা পান নিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এই অবস্থা। তারপর এই বছর পুজো এগিয়ে এসেছে। ছবিঃ ময়ূরেশ রায়চৌধুরী

সারাদিন ধরে ছবি আঁকে সুস্মিতা। সুস্মিতার বাবা পেশায় জেলে। সকালে উঠে নৌকা নিয়ে গঙ্গায় পারি দেয়, বিকেলে ফিরে এসে সেই মাছ নিয়ে হাটে বিক্রি করে। তবে এখন গঙ্গায় মাছের বাজারের অবস্থাও খারাপ, ইনকাম নেই। সুস্মিতার মা বাড়ির সামনে একটি ছোট দোকান দিয়েছেন পঞ্চায়েত থেকে লোন নিয়ে। তাঁর ইচ্ছে মেয়ে যেন নিজের ইচ্ছেমতো আঁকা নিয়েই পড়াশোনা করতে পারে৷ মেয়েকে আর্ট কলেজে ভর্তি করতে চান তিনি। কিন্তু কবে ঠাকুর মুখ তুলে দেখবেন সেই অপেক্ষায় দিন গুনছেন তাঁরা।